ব্যবসায় গুরুত্বের ধাপগুলো
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যবসায় উদ্যোগের গুরুত্ব
বাংলাদেশ একটি উন্নয়শীল দেশ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১০’ অনুযায়ী আমাদের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৫০ ভাগ আসে সেবা খাত থেকে, প্রায় ২০ ভাগ আসে কৃষি খাত থেকে আর বাকি ৩০ ভাগ আসে শিল্প খাত থেকে। যে কোনো দেশের উন্নয়নে শিল্পখাত মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে শিল্পখাতসহ সকল খাতেরই উন্নয়ন সম্ভব। ব্যবসায় উদ্যোগ নিম্নোক্তভাবে আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে::-
সম্পদের সঠিক ব্যবহার
ব্যবসায় উদ্যোগ আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে। তাছাড়া নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব।
জাতীয় উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি
ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়। ফলে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত জাতীয় আয় বৃদ্ধির লক্ষমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়।
নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি
সরকারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমেও দেশে শিল্প কারখানা স্থাপন, পরিচালনা ও সম্প্রসারণ হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে নিত্যনতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় যা বেকার সমস্যা দূর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। আমাদের এই বিশাল জনসংখ্যাই আমাদের সম্পদ হতে পারে। কারণ ব্যবসায় উদ্যোক্তা দেশের অদক্ষ জনগোষ্ঠীকে ঊৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করতে পারে।
পরনির্ভরশীলতা দূরীকরণ
ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা আমাদের পরনির্ভরশীলতা অনেকাংশে হ্রাস করতে পারি। ব্যবসায় উদ্যোগের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা একদিন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারব।
অনুকূল পরিবেশের উপাদান
ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশ
আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাই যে, তাদের অগ্রগতির একটি প্রধান কারণ হলো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও সম্প্রসারণের অনুকূল পরিবেশ। আমাদের দেশে মেধা, মনন ও দক্ষতার খুব বেশি ঘাটতি নেই। শুধুমাত্র অনুকূল পরিবেশের অভাবে আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠার জন্য নিম্নোক্ত অনুকূল পরিবেশ থাকা উচিত
উন্নত অবকাঠামোগত উপাদান
ব্যবসায় পরিচালনার জন্য আনুষঙ্গিক কিছু সুযোগ সুবিধা, যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও যাতায়াত ব্যবস্থা দরকার। ব্যবসায়ের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এই সকল উপাদান থাকা বাঞ্ছনীয়।
সরকারি পৃষ্ঠাপোষকতা
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে দেশের ব্যবসায় উদ্যোগের আরও সম্প্রসারণ ও সমৃদ্ধি সম্ভব। সরকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত যেমন কর মওকুফ, স্বল্প বা বিনা সুদে মূলধন সরবরাহ ইত্যাদি ব্যবসায় উদ্যোগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে।
আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা যেমন ব্যবসায় উদ্যোগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে, তেমনি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ব্যবসায় উদ্যোগের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
অনুকূল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে ব্যাবসায় স্থাপন ও পরিচালনা সহজ হয়। অন্যদিকে অস্থিতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যবসায় স্থাপন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে।
পর্যাপ্ত পুঁজির প্রাপ্যতা
যে কোনো ব্যবসায় উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণ পুঁজি বা মূলধন। মূলধনের স্বল্পতার কারণে অধিকাংশ ব্যবসায় স্থাপন ও পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। এজন্য দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে যাতে করে নতুন উদ্যোক্তারা পুঁজির যোগান পেতে পারে।
প্রশিক্ষণের সুযোগ
প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক সময় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যবসায়ের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব।
ঝুঁকি
ব্যবসায় উদ্যোগের সাথে ঝুঁকির সম্পর্ক সর্বদা বিদ্যমান। কোনো ব্যবসায়ে ঝুঁকি কম, আবার কোনো ব্যবসায়ে ঝুঁকি বেশি। যে ব্যবসায়ে ঝুঁকি বেশী তাতে লাভের সম্ভাবনাও বেশী। আবার যে ব্যবসায় ঝুঁকি কম তাতে লাভের সম্ভাবনাও কম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, মুদি দোকানে ঝুঁকি কম তাই মুনাফাও সীমিত। অন্যদিকে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের মতো ব্যবসায়ে যেমন অনেক লাভের সম্ভাবনা আছে তেমনি অত্যধিক ঝুঁকিও আছে।
ব্যবসায়ে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। যে কোনো সময় উৎপাদিত পণ্যের অথবা সরবরাহকৃত সেবার চাহিদা কমে যেতে পারে। এর ফলে অর্জিত মুনাফা কমে যেতে পারে। এই সম্ভাবনাই ব্যবসায়িক ঝুঁকি। অন্যদিকে দেখা গেল ব্যবসায় থেকে বছরে উদ্যোক্তা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা আশা করেছিল। কিন্তু বাস্তবে এর চেয়ে কম মুনাফা অর্জিত হয়েছে। এটিই হলো আর্থিক ঝুঁকি।
ব্যবসায় স্থাপন ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। অন্যদিকে ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে সাফল্যজনকভাবে লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে অধিক পরিমাণ আয় করাও সম্ভব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, একজন সফল উদ্যোক্তা সর্বদা ঝুঁকি আগেই নিরূপণ করেন এবং তা হ্রাসের ব্যবস্থা নেন এবং সবসময়ই পরিমিত পরিমাণ ঝুঁকি গ্রহণ করেন। মাত্রারিক্ত ঝুঁকি এবং অতি আত্মবিশ্বাস যেকোনো পরিকল্পনাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে পারে।
আর্থসামজিক উন্নয়নের ধারণা
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে উদীয়মান বাঘ হিসেবে খ্যাত। বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদগণ বলেছেন দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নে অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের সিংহভাগ সেবা ও কৃষি খাত থেকে আসলেও শতকরা ৩০ ভাগ আসে শিল্প খাত থেকে। সেই দেশকে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশ বলা হয়, যার মোট জাতীয় উৎপাদনের বেশির ভাগ আসে শিল্প খাত থেকে। ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে শিল্প খাতসহ সকল খাতের উন্নয়ন সম্ভব । ব্যবসায় উদ্যোগ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যেভাবে ভূমিকা বা অবদান রাখে তা নিম্নরূপ:
১। সম্পদের সদ্ব্যবহার: দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে ব্যবসায় উদ্যোগ দেশে নতুন নতুন ব্যবসায় গঠন ও শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে।
২। মূলধন গঠন: মূলধন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান গঠন বা নতুন কিছু উৎপাদন সম্ভব নয়। ব্যবসায় উদ্যোগ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন সঞ্চয়কে একত্রিত করে মূলধন গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৩। জাতীয় উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি: ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে দেশে মোট দেশজ উৎপাদন [Gross Domestic Product (GDP) ও মোট জাতীয় উৎপাদন [Gross National Product (GNP) বৃদ্ধি পায়। ফলে, মোট জাতীয় আয় (Total National Income) বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি মাথা পিছু আয়ও (Income Per Capita) বৃদ্ধি পায়।
৪। কর্মসংস্থান সৃষ্টি: বর্তমান উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে সরকারের পুরোপুরি কর্মসংস্থানের দায়িত্বভার নেয়ার সুযোগ নেই। বরং রাষ্ট্র এরূপ সহায়ক ভূমিকা পালন করে যাতে দেশে বেসরকারি মালিকানায় নতুন নতুন শিল্প কল-কারখানা, ব্যবসায় ইউনিট গড়ে উঠে এবং নিত্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর এটা ব্যবসায় উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়।
৫। দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি: বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের অদক্ষ জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োজিত করে দক্ষ মানব সম্পদে রূপান্তর করা যায়। জাপান এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৬। পরনির্ভরশীলতা হ্রাস: যে সকল পণ্য ও সেবাকর্ম বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে শিল্প, কল-কারখানা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করে ঐ সকল পণ্য ও সেবাকর্ম উৎপাদন করে পরনির্ভরতা দূর করা যায়।
৭। শিল্পোন্নয়ন: ব্যবসায় উদ্যোগের অর্থাৎ দক্ষ ও সৃজনশীল উদ্যোক্তাদের দ্বারাই নতুন নতুন ব্যবসায় সংগঠন স্থাপন, পণ্য ও সেবাকর্ম উৎপাদন এবং আধুনিকায়নের মাধ্যমে শিল্পোন্নয়ন ঘটে থাকে।
৮। বিনিয়োগ বৃদ্ধি: ব্যবসায় উদ্যোগের দ্বারা দেশে এরূপ ব্যবসায় বান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়, যার ফলে দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারী নতুন নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে।
৯। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ব্যবসায় উদ্যোগের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়।
১০। প্রযুক্তির উন্নয়ন: প্রযুক্তি সতত পরিবর্তনশীল। উন্নত গবেষণার মাধমে ব্যবসায় উদ্যোগ বা উদ্যোক্তা ক্রমাগতভাবে লাগসই প্রযুক্তি সংগ্রহ ও ব্যবহার করেন। ফলে দেশের প্রযুক্তির বিকাশ ও উন্নয়ন হয়ে থাকে।