একটি পতিত জলাশয় ও মাছ চাষের জন্য আদর্শ পুকুর পর্যবেক্ষণ করলে এদের মধ্যে বসবাসকারী জীব সম্প্রদায় ও পরিবেশের মধ্যে যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তার উপর চিত্রসহ একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলো।
পুকুর হচ্ছে ছোট ও অগভীর বদ্ধ জলাশয়, যেখানে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে মাছ চাষ করা যায় এবং প্রয়োজনে এটিকে সহজেই সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে ফেলা যায়। এক কথায় পুকুর হচ্ছে চাষযোগ্য মাছের বাসস্থান। পুকুরে পানি স্থির অবস্থায় থাকে। তবে বাতাসের প্রভাবে এতে অল্প ঢেউ সৃষ্টি হতে পারে। পুকুরের আয়তন কয়েক শতাংশ থেকে কয়েক একর হতে পারে। তবে ছোট ও মাঝারি আকারের পুকুর ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সুবিধাজনক এবং এই ধরনের পুকুর অধিকতর উৎপাদনশীল হয়।
আদর্শ পুকুরের বৈশিষ্ট্য
মাছ চাষের পুকুরের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার যা চাষ প্রক্রিয়াকে লাভজনক করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। একটি আদর্শ মাছ চাষের পুকুরের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা প্রয়োজন
১। পুকুরটি বন্যামুক্ত হবে। এজন্য পুকুরের পাড় যথেষ্ট উঁচু হতে হবে।
২। পুকুরের মাটি দোআঁশ, পলি দোআঁশ বা এঁটেল দোআঁশ হলে সবচেয়ে ভালো।
৩। সারা বছর পানি থাকে এমন পুকুর চাষের জন্য অধিক উপযুক্ত।
৪। পুকুরের পানির গভীরতা ০.৭৫-২ মিটার সুবিধাজনক।
৫। পুকুরটি খোলামেলা স্থানে হলে ভালো হয় এবং পাড়ে কোনো বড় গাছপালা না লাগালে ভালো হয়। এতে পুকুর প্রচুর আলো-বাতাস পাবে। ফলে পুকুরে সালোকসংশ্লেষণ বেশি হবে ও মাছের খাদ্য বেশি তৈরি হবে। পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন মিশবে। উত্তর-দক্ষিণমুখী পুকুর সূর্যালোক বেশি পাবে।
৬। পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদা থাকা উচিত নয়। তলার কাদার পুরুত্ব ২০-২৫ সেমি এর বেশি হওয়া ঠিক নয়।
৭। চাষের পুকুরের আয়তন ২০-২৫ শতক হলে ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। পুকুরের আকৃতি আয়তাকার হলে ভালো। এতে করে জাল টেনে মাছ আহরণ করা সহজ হয়।
৮। পুকুরের পাড়গুলো ১৪২ হারে চালু হলে সবচেয়ে ভালো। অর্থাৎ পুকুরের তলা হতে পুকুরের পাড় যতটুকু উঁচু হবে পাড় ঢালু হয়ে পুকুরের তলার দিকে দ্বিগুণ দূরত্বে গিয়ে মিশবে।
মাছ চাষের পুকুরের পানির গুণাগুণ
মাছের বেঁচে থাকা, খাদ্যগ্রহণ ও আশানুরূপ বৃদ্ধির জন্য পুকুরের পানির গুণাগুণ অনুকূল মাত্রায় থাকা দরকার। পুকুরে পানির গুণাগুণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ১) ভৌত গুণাগুণ ২) রাসায়নিক গুণাগুণ। মাছ চাষে এদের প্রভাব সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো
১। ভৌত গুণাগুণ
ক) গভীরতা পুকুর বেশি গভীর হলে সূর্যের আলো পুকুরের অধিক গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। ফলে অধিক গভীর অঞ্চলে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য প্লাংকটন তৈরি হয় না। আবার সেখানে অক্সিজেনের অভাব হতে পারে। অন্যদিকে পুকুর অগভীর হলে গ্রীষ্মকালে পুকুরের পানি অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। এসব কারণে মাছের ক্ষতি হতে পারে ও উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
খ) তাপমাত্রা: তাপমাত্রার বৃদ্ধির উপর মাছের বৃদ্ধি নির্ভর করে। যেমন- শীতকালে মাছ খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দেয় ফলে মাছের বৃদ্ধি কমে যায়। এ কারণে শীতকালে পুকুরে সার ও খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। রুই জাতীয় মাছের বৃদ্ধি ২৫-৩০°সে. তাপমাত্রা সবচেয়ে ভালো হয়।
গ) ঘোলাত্ব: কাদা কণার কারণে পুকুরের পানি ঘোলা হলে পানিতে সূর্যালোক প্রবেশে বাধা পায়। এতে করে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। ঘ) সূর্যালোক যে পুকুরে সূর্যালোক বেশি পড়ে সেখানে সালোকসংশ্লেষণ ভালো হয়। ফলে সেখানে ফাইটোপ্লাংটন বেশি উৎপাদিত হয় ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
২। রাসায়নিক গুণাগুণ
ক) দ্রবীভূত অক্সিজেন: পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন মাছ চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানত ফাইটোপ্লাংকটন ও জলজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন তৈরি করে পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত হয়। বায়ুমণ্ডল হতে সরাসরি পানির উপরিভাগেও কিছু অক্সিজেন মিশ্রিত হয়। পুকুরে বসবাসকারী মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণী এ অক্সিজেন দ্বারা শ্বাসকার্য চালায়। রাতে সূর্যালোকের অভাবে সালোকসংশ্লেষণ হয় না বলে পানিতে কোনো অক্সিজেন তৈরি হয় না। এজন্য সকালে পুকুরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় ও বিকেলে বেশি থাকে। মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমপক্ষে ৫ মিলি গ্রাম/লিটার (৫ পিপিএম বা ১ মিলিয়ন ভাগের পাঁচ ভাগ) থাকা প্রয়োজন
খ) দ্রবীভূত কার্বন ডাইঅক্সাইড: পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য ফাইটোপ্লাংকটনের উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত দ্রবীভূত কার্বন ডাইঅক্সাইড থাকা প্রয়োজন। তবে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড মাছের জন্য ক্ষতিকর। পানিতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা ১২ মিলি গ্রাম/লিটারের (১২ পিপিএম) নিচে থাকলে তা মাছ ও চিংড়ির জন্য বিষাক্ত নয়। মাছের ভালো উৎপাদন পাওয়ার জন্য পুকুরের পানিতে ১-২ পিপিএম কার্বন ডাইঅক্সাইড থাকা প্রয়োজন।
গ) পিএইচ (pill): পুকুরের পানির pH মান নির্ণয় করে অম্লত্ব বা ক্ষারত্বের মাত্রা বোঝা যায়। মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানির pH ৬.৫ হতে ৮.৫ এর মধ্যে হলে ভালো হয়। pH ৪ এর নিচে বা ১১ এর উপরে হলে মাছ মারা যায়। পানির pH কমে অম্লীয় হয়ে গেলে পুকুরে চুন (১-২ কেজি/শতক) প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে pil বেড়ে ক্ষারীয় অবস্থা বেশি বেড়ে গেলে এমোনিয়াম সালফেট বা তেঁতুল পানিতে গুলে পুকুরে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ঘ) ফসফরাস প্রাকৃতিক পানিতে অতি অল্প পরিমাণ ফসফরাস থাকে। এই ফসফরাস ফসফেটে রূপান্তরিত হয়। পরিমিত ফসফেটের উপস্থিতিতে প্রচুর পরিমাণ ফাইটোপ্লাংটন জন্মায়।
পুকুরের প্রকারভেদ ও এর বিভিন্ন স্তর
পুকুরের প্রকারভে
পানি ধারণক্ষমতা, পুকুরে মাছের ধরন, পুকুরের আয়তন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে পুকুরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। নিচে পুকুরের প্রধান প্রধান শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করা হলো
১। পানির স্থায়িত্বের উপর ভিত্তি করে পুকুরের শ্রেণিবিভাগ
ক) স্থায়ী বা বার্ষিক পুকুর এসব পুকুরে সারা বছর পানি থাকে। এ ধরনের পুকুর অধিক গভীর হয়। এদের মাটি সবসময় পানি ধরে রাখতে পারে। যেমন- এঁটেল ও দোঁআশ মাটির পুকুর। এসব পুকুরে দেশীয় কার্প জাতীয় মাছ, যেমন- রুই, কাতলা, মৃগেল, কার্পিও ইত্যাদির মিশ্র চাষ, গলদা চিংড়ি ও কার্পের মিশ্র চাষ করা যায়।
খ) অস্থায়ী বা মৌসুমি পুকুর। এসব পুকুরে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় (৩-৮মাস) পানি থাকে। এগুলো বেশি গভীর হয় না। এদের মাটি বেশি সময় পানি ধরে রাখতে পারে না। যেমন বেলে মাটির পুকুর। এসব পুকুরে দ্রুত বর্ধনশীল মাছ যেগুলো এক বছরের কম সময়ে বাজারজাত করার উপযোগী হয় সেসব মাছ চাষ করা যায়। যেমন- সিলভার কার্প, তেলাপিয়া, সরপুঁটি, শিং, মাগুর ইত্যাদি।
২। চাষকৃত মাছের বয়সের উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিভাগ
মাছের পোনাকে বয়স ও দৈর্ঘ্য অনুপাতে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথা- ডিম পোনা রেণু পোনা, ধানী পোনা ও আঙ্গুলে বা চারা পোনা। ডিম ফোটার পরের অবস্থাকে ডিম পোনা বলে। এদের পেটের নিচে একটি থলি থাকে। থলি থাকা অবস্থায় (২-৩দিন) এরা বাইরে থেকে কোনো খাদ্য গ্রহণ করে না। কুসুম থলি শেষ হয়ে যাওয়ার পরবর্তী অবস্থাকে রেণু পোনা বলে রেণু পোনা আরও বড় হয়ে ধানের মতো আকার (যেমন – ২ বা ২ সেমি এর উপর) হলে একে ধানী পোনা এবং আঙ্গুলের মতো লম্বা (৭ সেমি এর উপর) হলে একে আঙ্গুলে বা চারা পোনা বলে। বিভিন্ন আকারের পোনার প্রতিপালনের জন্য বিভিন্ন পরিবেশের পুকুর প্রয়োজন। নিম্নে এদের বর্ণনা দেওয়া হলো
ক) আঁতুড় বা নার্সারি পুকুর: যে পুকুরে রেণু পোনা ছেড়ে ধানী পোনা পর্যন্ত বড় করা হয় তাকে আঁতুড় বা নার্সারি পুকুর বলে। এখানে শতক প্রতি ৫০-১০০ গ্রাম রেণু পোনা ছেড়ে ১৫-৩০ দিন চাষ করা হয়।
খ) লালন পুকুর: যে পুকুরে ধানী পোনা ছেড়ে চারা বা আঙ্গুলে পোনা পর্যন্ত বড় করা হয় তাকে লালন পুকুর বলে। লালন পুকুরের আয়তন ২০ থেকে ১০০ শতক ও গভীরতা ১.৫-২ মিটার হতে পারে। এ পুকুরে শতক প্রতি ২৫০০-8000 টি ধানী পোনা ছেড়ে ২-৩ মাস চাষ করা হয়।
গ) মজুদ পুকুর: এটিই মাছ চাষের প্রধান পুকুর যে পুকুরে ধানী বা আঙ্গুলে পোনা ছেড়ে বড় মাছে পরিণত করা হয় তাকে মজুদ পুকুর বলে। এর আয়তন ৩০ শতকের উপরে এবং গভীরতা ২-৩ মিটার হয়। এখানে সাধারণত ১ বছরের উপরে মাছ লালন না করাই ভালো। কারণ খাদ্য দিলেও এ সময়ের পর মাছের বৃদ্ধির হার কম হয়।
এছাড়া আয়তনের উপর ভিত্তি করেও পুকুরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- মিনি পুকুর বা ছোট পুকুর (১-৫ শতক), মাঝারি পুকুর (১০-৩০ শতক) এবং বড় পুকুর (৩০ শতকের উপর)।
পুকুরের বিভিন্ন স্তর
পুকুরের পানির বিভিন্ন গভীরতা ভেদে তাপমাত্রা, অক্সিজেন ও প্লাংকটনের তারতম্য ঘটে। পুকুরে বিচরণকারী বিভিন্ন মাছ ভিন্ন ভিন্ন গভীরতায় থাকে ও খাদ্য গ্রহণ করে। এই সব তারতম্য অনুযায়ী পুকুরকে ৩টি স্তরে ভাগ করা যায়। যথা- (১) উপরের স্তর (২) মধ্যস্তর এবং (৩) নিচের স্তর
১) উপরের স্তর বা উপরিভাগ পুকুরের উপরের স্তর যেহেতু বাতাসের সংস্পর্শে থাকে তাই এই স্তরে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে। পুকুরের উপরের স্তরে ফাইটোপ্লাংকটন বেশি থাকে যা মাছের খাদ্য। এই স্তরে সরপুঁটি, কাতলা, সিলভার কার্প, বিগহেড কার্প থাকে ও খাদ্য গ্রহণ করে।
২) মধ্যস্তর বা মধ্যভাগ এই স্তরে পানির তাপমাত্রা ও দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ উপরের স্তরের চেয়ে কম থাকে। এই স্তরে ঘু-প্লাংকটন থাকে তবে ফাইটোপ্লাংকটনও থাকতে পারে। বুই মাছ এই স্তরে থাকে ও খাদ্য গ্রহণ করে।
৩) নিচের স্তর বা তলদেশ। এই স্তরে দ্রবীভূত অক্সিজেন ও তাপমাত্রা সবচেয়ে কম থাকে। পুকুরের তলদেশে জু-প্লাংকটন, কীটপতঙ্গের লার্তা, জৈব-আবর্জনা, কেঁচো, শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়। মৃগেল, কালবাউশ, কার্পিও বা কমন কার্প, চিংড়ি, পাঙ্গাশ, শিং, মাওর এই স্তরে বাস করে ও খাদ্য গ্রহণ করে।
কিছু মাছ আছে যারা পুকুরের সকল স্তরেই বিচরণ করে যেমন- তেলাপিয়া। অন্যদিকে গ্রাস কার্প পুকুরের উপরে পাড়ে বা তলদেশে জন্মানো বিভিন্ন সবুজ উদ্ভিদ খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে।
পুকুরের বসবাসকারী জীব সম্প্রদায়
অবস্থান বা বাসস্থানের উপর ভিত্তি করে পুকুরে বসবাসকারী জীব সম্প্রদায় বা জীবকুলকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা
১) প্লাংকটন প্লাংকটন হচ্ছে পানিতে মুক্তভাবে ভাসমান আণুবীক্ষণিক জীব। এরা দুই প্রকার যথা ফাইটোপ্লাংকটন বা উদ্ভিদকণা ও ফ্লু-প্লাংকটন বা প্রাণিকণা। পুকুরের পানির রং সবুজ বা সবুজাভ থাকলে বুঝতে হবে পানিতে ফাইটোপ্লাংকটন আছে। ফাইটোপ্লাংকটনকে এককোষী শেওলাও বলে। কয়েকটি ফাইটোপ্লাংকটনের উদাহরণ হচ্ছে ক্লোরেলা, এনাবেনা, মাইক্রোসিস্টিস ইত্যাদি। আর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জু-প্লাংকটন হচ্ছে ড্যাফনিয়া, কপিপোড, রটিফার। পানির রং বাদামি সবুজ, লালচে সবুজ বা হলদেটে সবুজ থাকলে বুঝতে হবে ফাইটোপ্লাংকটনের পাশাপাশি পুকুরে জু-প্লাংকটনের উপাদানও ভালো। পুকুরে প্লাংকটনের উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা করে নিয়মিত সার ব্যবহার করতে হয়। সার হিসাবে জৈব ও অজৈব এ দুধরনের সারই ব্যবহার করা যায়।
২) সাঁতারু বা নেকটন এরা মুক্তভাবে সাঁতার কাটতে পারে। এরা সমস্ত পানিতে চরে বেড়ায় এবং খাদ্য খুঁজে খায় যেমন- মাছ, ব্যাঙ ইত্যাদি। অবশ্য এদের ডিম ও লার্ভার বৈশিষ্ট্য প্লাংকটনের মতো।
৩) তলবাসী বা বেনথোস পুকুরের তলদেশে কাদার উপরে বা ভিতরে যে সব জীব থাকে তাদেরকে তলবাসী বা বেনথোস বলে। যেমন- পচনকারী ব্যাকটেরিয়া, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি। তলবানী প্রাণী পুকুরের তলা থেকে প্লাংকটনের পুষ্টি উপাদান নাইট্রোজেন ও ফসফরাস যুক্ত করতে সাহায্য করে। ফলে পানিতে প্লাংকটনের পুষ্টি উপাদান বাড়ে যা মাছ চাষের জন্য ভালো।
৪) জলজ উদ্ভিদ: পুকুরে বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ জন্মায়। যেমন শেওলা অগভীর পুকুরের তলদেশে বা পুকুর পাড়ে বিভিন্ন ধরনের শেওলা জন্মে। যেমন-স্পাইরোগাইরা।
ভাসমান উদ্ভিদ
এ সকল উদ্ভিদ পানিতে ভেসে থাকে। এদের মূল মাটিতে আটকানো থাকে না। যেমন কচুরিপানা, টোপাপানা, খুদিপানা ইত্যাদি।
নির্গমশীল উদ্ভিদ
এ সব উদ্ভিদের শিকড় পানির নিচে মাটিতে থাকে পাতা কাজের উপরের অংশ বা শুধু পাতা পানির উপর দাঁড়িয়ে থাকে বা ভেসে থাকে। যেমন– শাপলা, পানিফল, সমি শাক, আড়াইল।
নিমজ্জিত বা ডুবন্ত উদ্ভিদ
এ ধরনের জলজ উদ্ভিদ পানির তলদেশে থাকে। এদের শিকড় মাটিতে থাকে। এদের পাতা ও ডাল কখনো পানির উপরে আসে না। যেমন কাঁটাৰীঝি পাতাঝাঝি, পাতাশেওলা, নাজাস
লতানো উদ্ভিদ
এদের শিকড় পুকুরের পাড়ে আটকানো থাকে এবং কাণ্ড, পাতা পানিতে ছড়িয়ে থাকে। যেমন- হেলেঞ্চা, কলমিলতা, মালঞ্চ।
পুকুরকে চাষের জন্য প্রস্তুতকরণ বা উপযোগীকরণ
মাছ চাষের জন্য সর্বপ্রথম যেটি প্রয়োজন তা হচ্ছে নতুন পুকুর খনন অথবা বিদ্যমান পুকুরকে চাষের জন্য প্রস্তুতকরণ বা উপযোগীকরণ নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো
ক. নতুন পুকুর খনন
কোনো স্থানে পুকুর খনন করতে হলে একটি আদর্শ পুকুরের যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার যথাসম্ভব সেগুলো বজায় রেখে পুকুর খনন করতে হবে। পুকুর খননের সময় পুকুরটি যথাসম্ভব আয়তকার রাখার চেষ্টা করতে হবে। পুকুরের গভীরতা এমন ভাবে করা প্রয়োজন যেন সারা বছর ১.৫ থেকে ২ মিটার পানি থাকে। খননের সময় পুকুরের পাড়ের ঢাল ন্যূনতম ১.৫৪২ রাখা উচিত। তবে মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি হলে ১৪৩ করা নিরাপদ অন্যথায় পুকুরের পাড় ভেঙে গিয়ে অল্প দিনে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়বে। পুকুর খননের স্থানে যদি উপরের মাটি ভালো ও উর্বর হয় তবে পুকুর খননের সময় আলাদা করে সরিয়ে রাখতে হবে। পুকুর খনন শেষ হলে পুকুরের তলায় বালু মাটির উপরে তা বিছিয়ে দিতে হবে। এতে পুকুরের পানি ধারণ ক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। পুকুরের পাড়ের উপরিভাগে ২.৫ মিটার চওড়া হলে ভালো। পুকুরের উপরিতলের ধার ও পাড়ের মধ্যবর্তী কিছু স্থান ফাঁকা রাখা হয়। ঐ জায়গাটুকুকে বকচর বলে। পুকুরের তলা সমান অথচ একদিকে কিছুটা ঢালু করতে হবে। এতে পানি সেচ ও মাছ আহরণে সুবিধা হবে। নতুন পুকুর খননের পর দরমুজ দিয়ে পিটিয়ে পাড়ের মাটি শক্ত করে দিতে হবে এবং পাড়ে ঘাস লাগিয়ে দিতে হবে। এতে করে পাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে ও বর্ষায় পাড়ের মাটি ক্ষয়ে যাবে না।
খ. পুকুর প্রস্তুতকরণ বা মাছ চাষের উপযোগীকরণ
পুকুর প্রস্তুতি মাছ চাষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাছ পালনের পূর্বে বিদ্যমান পুকুর সংস্কারের মাধ্যমে ডালোভাবে প্রস্তুত করে নিলে মাছ স্বাস্থ্যসম্মত বসবাসের অনুকূল পরিবেশ পায়। এতে মাছের দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে ও রোগ বালাই কম হয়। ফলে মাছ উৎপাদন লাভজনক হয়। পুকুর প্রস্তুতির প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধারাবাহিক ধাপে সম্পন্ন করতে হয়। ধাপ গুলো নিম্নরূপ-
১. পুকুরের পাড় ও তলদেশ মেরামত
পুকুরের পাড় ভাঙা থাকলে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে বা বর্ষাকালে বন্যায় মাছ ভেসে যেতে পারে বা রাক্ষুসে মাছ ঢুকতে পারে। তাই পাড় ভাঙা থাকলে মেরামত করতে হবে ও পাড় উঁচু করে বাঁধতে হবে। পাড়ে বড় গাছপালা থাকা উচিত নয় বা থাকলেও তা ছেটে দিতে হবে। এতে করে পুকুরে সূর্যের আলো পড়বে এবং পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হবে। পুকুর পুরানো হলে তলায় অতিরিক্ত কাদা জমা হয়। এ অবস্থায় ২০-২৫ সেমি কাদা রেখে অতিরিক্ত কাদা তুলে ফেলতে হবে। পুকুর শুকিয়ে সহজেই তা করা যায়। মাছ চাষের পুকুরে ৩-৪ বছর পর পর একবার শুকানো উচিত। পুকুর শুকানোর পর কড়া রোদে তলায় ফাটল ধরাতে হবে। সম্ভব হলে পুকুরের তলায় চাষ দিয়ে নিতে হবে। এতে করে পুকুরের তলা থেকে বিষাক্ত গ্যাস, ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও পোকামাকড় দূর হবে এবং পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকবে। এরপর পুকুরের তলদেশ সমান করে নিতে হবে। পুকুরের তলায় একদিকে কিছুটা ঢালু হলে ভালো হয়। এতে মাছ ধরতে ও জাল টানতে সুবিধা হবে।
২. জলজ আগাছা দমন
পুকুর পাড়ে ও ভিতরে বিভিন্ন আগাছা যেমন কচুরিপানা, খুদিপানা, হেলেঞ্চা, কলমি লতা, শেওলা ইত্যাদি থাকলে তা ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। আগাছা পুকুরে দেওয়া সার শোষণ করে নেয়, সূর্যের আলো পড়তে বাধা দেয় এবং মাছের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা দেয়। আগাছার মধ্যে মাছের শত্রু যেমন রাক্ষুসে মাছ, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি লুকিয়ে থাকে ও মাছ ধরে খায়। বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য যেমন-কপার সালফেট বা তুঁতে, সিমাজিন ইত্যাদি ব্যবহার করেও জলজ আগাছা দমন করা যায়। তবে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা কাঙ্ক্ষিত নয়। গ্রাসকার্প, সরপুঁটি উদ্ভিদভোজী মাছ চাষকালীন সময়ে পুকুরে এসব মাছ ছেড়ে জৈবিক পদ্ধতিতেও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৩. রাক্ষুসে ও অচাষযোগ্য মাছ দূরীকরণ
বিভিন্ন রাক্ষুসে মাছ যেমন-শোল, বোয়াল, চিতল, ফলি, টাকি, গজার ইত্যাদি সরাসরি চাষের মাছ খেয়ে
ফেলে। এছাড়া পুঁটি, চাপিলা, চান্দা ইত্যাদি অচাষযোগ্য মাছ। এরা চাষযোগ্য মাছের জায়গা, খাদ্য, অক্সিজেন সবকিছুতেই ভাগ বসায়। এর ফলে চাষকৃত মাছের উৎপাদন কমে যায়। নিচের যে কোনো পদ্ধতিতে রাক্ষুসে ও আবাদযোগ্য নয় এমন মাছ দূর করা যায়
ক) পুকুর শুকিয়ে পুকুরের পানি শুকিয়ে সব মাছ ধরে ফেলা যায়। অনেক মাছ পুকুরের তলায় কাদায় লুকিয়ে থাকতে পারে। তাই কড়া রোদে পুকুর শুকিয়ে ফেলতে হবে। খ) জাল টেনে পুকুরে পানি কম থাকলে বার বার জাল টেনে মাছ ধরে ফেলা যায়।
গ) মাছ মারার বিষ ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে রোটেনন বা মহুয়ার খৈল ব্যবহার করা যায়। এসব দ্রব্য পুকুরে দিলে মাছের ফুলকার ছিদ্র বন্ধ করে দেয়। ফলে মাছ দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। পুকুরে ১ ফুট বা ৩০সেমি গভীরতায় পানির জন্য শতক প্রতি ৩০-৩৫ গ্রাম রোটেনন অথবা ৩ কেজি মহুয়ার খৈল ব্যবহার করতে হবে। এজন্য মোট পরিমাণকে তিন ভাগ করতে হবে। একভাগ দিয়ে কাই তৈরি করে ছোট ছোট বল বানিয়ে পুকুরের বিভিন্ন স্থানে দিতে হবে। বাকি ২ ভাগ পানিতে গুলিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর জাল টেনে পুকুরের পানি উলট-পালট করে দিতে হবে। মাছ ভাসতে শুরু করলে জাল টেনে ধরে ফেলতে হবে। বিষ দেওয়ার পর ৭-১০ দিন পুকুরের পানি ব্যবহার করা যাবে না ও নতুন মাছ ছাড়া যাবে না। রোটেনন ব্যবহারে মৃত মাছ খাওয়া যাবে। পুকুরে বিভিন্ন রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করেও মাছ মারা যায় যেমন ফসটক্সিন ট্যাবলেট। তবে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে মাছ মারা ঠিক নয়।