ক) জিডিপির সংজ্ঞা ও বর্ণনা:
মােট দেশজ উৎপাদন (Gross Domestic Product বা GDP)
একটি নির্দিষ্ট সময়ে সাধারণত এক বছরে একটি দেশের ভৌগােলিক সীমানার মধ্যে মােট যে পরিমাণ চূড়ান্ত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদিত হয়, তার বাজার দামের সমষ্টিকে মােট দেশজ উৎপাদন বা GDP বলে।
মনে করি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বছরে তিনটি দ্রব্য উৎপাদিত হয়। যেমন- ১০০ কুইন্টাল ধান, ১০০০ জামা এবং ১০০০ কলম উৎপাদিত হয় । জিডিপি = ১০০ কুইন্টাল ধান x ধানের বাজার দাম + ১০০০ জামা x জামার বাজার দাম + ১০০০ কলম X কলমের বাজার দাম। এভাবে কোনাে দেশে উৎপাদিত সকল দ্রব্যের পরিমাণকে নিজ নিজ দাম দ্বারা গুণ করে তার সমষ্টি বের করে জিডিপি নির্ণয় করা হয়। তবে ধান থেকে যদি চূড়ান্ত দ্রব্য হিসাবে চাল তৈরি হয়, তাহলে আমাদেরকে হিসাবের সময় ধানের বদলে চাল উৎপাদন এবং চালের দামকে হিসাবে নিতে হবে।
খ) জিডিপি পরিমাপের তিনটি পদ্ধতি:
একটি দেশের সকল জনগণ সম্পদ, শ্রম ও মূলধন ব্যবহার করে মোট যে পরিমাণ চূড়ান্ত দ্রব্য ও সেবাসমূহ উৎপাদন করে তার বাজার মূল্যকেজাতীয় আয় বলে। জাতীয় আয় পরিমাপ করার জন্য তিনটি পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে থাকে।
১। উৎপাদন পদ্ধতি
২। আয় পদ্ধতি
৩। ব্যয় পদ্ধতি
১। উৎপাদন পদ্ধতি: উৎপাদন পদ্ধতিতে প্রথমে একটি নিদিষ্ট সময়ে সাধারনত এক বছর একটি দেশের সকল জনগণ দ্বারা যে পরিমাণ চূড়ান্ত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদিত হয় তার আর্থিক মূল্য হিসাব করে মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP) নির্ণয় করা হয়।
বদ্ধ অর্থনীতিতে GNP = GDP হয়। আবার মুক্ত অর্থনীতির GDP এর সাথে নীট রপ্তানি আয় (X-M) যুক্ত হয়।
অর্থাৎ GNP= GDP+(X-M)| GNP হতে মূলধনী দ্রব্যের ক্ষয়-ক্ষতিজনিত ব্যয় (CCA) বিয়োগ করলে NNP পাওয়া যায়, অর্থাৎ NNP= GNP- CCA
এখানে, CCA মূলধনী দ্রব্যের ক্ষয়-ক্ষতি জনিত ব্যয়।
এখন নীট জাতীয় উৎপাদন হতে পরোক্ষ কর (Ti), হস্তান্তর পাওনা (Tr) এবং সরকারের উদ্বৃত্ত মুনাফা (Sg) বিয়োগ
করে এবং সরকারি ভর্তুকি(Sg) যোগ করলে জাতীয় আয় (Y) পাওয়া যায়। অর্থাৎ,
Y= NNP- (Ti+Tr+Sg)+Sb
বা, Y=NNP-Ti-Tr-Sg+Sb
২। আয় পদ্ধতি: আয় পদ্ধতি অনুসারে উৎপাদনের সকল উপকরণের আয় যোগ করলে জাতীয় আয় পাওয়া যায়। উৎপাদনের চারটি উপকরণ ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠনের নিজ নিজ আয় সমূহ হচ্ছে যথাক্রমে খাজনা, মজুরি, সুদ ও মুনাফা। জাতীয় আয় হচ্ছে এ চার ধরণের আয়ের যোগফল। অন্যদিকে, ব্যক্তিগত আয়ের মধ্যে যদি হস্তান্তর পাওনা অন্তর্ভূক্ত থাকে তাহলে সেটি বিয়োগ করতে হবে। কারণ হস্তান্তর পাওনা জাতীয় আয়ে অন্তর্ভূক্ত হয় না।
জাতীয় আয়= খাজনা+ মজুরি+সুদ+ মুনাফা- হস্তান্তর পাওনা।
৩। ব্যয় পদ্ধতি: ব্যয় পদ্ধতিতে একটি দেশে একটি নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক অর্থবছরে) মোট ভোগ ব্যয় ও বিনিয়োগ ব্যয় যোগ করলে জাতীয় আয় পরিমাপ করা যায়। এক বছরে উৎপাদন কার্যের ফলে যে মোট আয় হয় তার একটি অংশ ভোগের জন্য ব্যয় হয় এবং বাকি অংশ সঞ্চয় হয়। আর এ সঞ্চয় পূণরায় উৎপাদন কাজে ব্যয় হয় যেটাকে আমরা বিনিয়োগ বলে থাকি। আর এ বিনিয়োগকে বিনিয়োগ ব্যয় বলা হয়। অতএব বলা যায় যে, একটি অর্থবছরে দেশে যে ভোগ ব্যয় হয় এবং মূলধন সম্পদ বৃদ্ধির জন্য যে বিনিয়োগ হয় তাদের সমষ্টিই হল জাতীয় আয়।
অর্থাৎ জাতীয় আয়= মোট ভোগ ব্যয়+ মোট বিনিয়োগ ব্যয়
বা, Y= C+I
অন্যদিকে মুক্ত অর্থনীতিতে সরকারি খাত এবং আমদানি-রপ্তানি বিবেচনা করতে হয়। তাই এ খাতগুলো বিবেচনা করলে ব্যয় পদ্ধতিতে জাতীয় আয় হবে, মোট ভোগ ব্যয় (C), মোট বিনিয়োগ ব্যয় (I), মোট সরকারি ব্যয় (G) এবং নীট রপ্তানি আয় (X-M) এর যোগফল। অর্থাৎ Y= C+I+G+(X-M)
গ) বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য পদ্ধতির বর্ণনা:
বাংলাদেশে জাতীয় আয় গণনার কাজটি করে থাকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এই প্রতিষ্ঠান প্রত্যেক বছর চলতি বাজার মূল্যে ও স্থির মূল্যে দ্রব্য ও সেবার মূল্য পরিমাপ করে থাকে। এ হিসাব করার জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো GDP ও GNI গণনা করার জন্য উৎপাদন ও ব্যয় পদ্ধতি ব্যবহার করে। উৎপাদন পদ্ধতিতে GDP পরিমাপের জন্য অর্থনীতিকে মোট ১৫টি প্রধান খাতে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। খাতসমূহ হচ্ছে:
১. কৃষি ও বনজ সম্পদ: কৃষি দেশজ উৎপাদনের একটি অন্যতম খাত। GDP গণনা করতে এই খাতকে তিনটি উপখাতে বিভক্ত করা হয়ে থাকে।
ক. শস্য ও শাকসবজি: এ খাতে দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ চলতি পাইকারি বাজার মূল্যে প্রেক্ষিতে হিসাব করা হয়ে থাকে।
খ. প্রাণি সম্পদ: চলতি বাজার মূল্যে এ খাতের দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ হিসাব করা হয়।
গ. বনজ সম্পদ: এ খাতের উপকরণের তথ্যের অভাবে মোট উৎপাদন হতে ৩% মূল্য বাদ দিয়ে যা থাকে তাকে মূল্য সংযুক্তি হিসাবে বিবেচনা করে GDP হিসাব করা হয়।
২. মৎস্য সম্পদ: অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক উৎস থেকে মোট মৎস্য আহরণের পরিমাণ থেকে GDP অংশ হিসাব হয়।
৩. খনিজ ও খনন: এই খাত দুটি উপখাতে বিভক্ত –
(ক) প্রাকৃতিক গ্যাস ও অপরিশোধিত তেল
(খ) অন্যান্য খনিজ সম্পদ। এ খাতে চলতি বাজার মূল্যে হিসাব করে আয় পরিমাপ করা হয়।
৪. শিল্প: শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের চলতি বাজার মূল্যে হিসাব করে জিডিপি গণনা করা হয়। এই খাত দুই ভাগে বিভক্ত-
(ক) বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প
(খ) ক্ষুদ্রায়তন শিল্প।
৫. বিদ্যুাৎ গ্যাস ও পানি: এ খাত একটি সেবা খাত। এ সেবা খাতের সেবা সরবরাহ মূল্যের প্রেক্ষিতে জিডিপি’র অংশ হিসাব করা হয়।
৬. নির্মাণ: নির্মাণ খাতের হিসাব করা হয় সরকারি বেঁধে দেওয়া মূল্যের প্রেক্ষিতে।
৭. পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য: এ খাতে পণ্যের পাইকারি মূল্যের হিসাবে জিডিপি গণনা করা হয়।
৮. হোটেল ও রেস্তোরা: এ খাতে দ্রব্য উৎপাদন ও সেবার হিসাব বিক্রয়মূল্যের দ্বারা করা হয়।
৯. পরিবহণ, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ: এ খাতটি ৫টি উপখাতে বিভক্ত।
(ক) স্থল পথ পরিবহণ
(খ) পানি পথ পরিবহণ
(গ) আকাশ পথ পরিবহণ
(ঘ) সহযোগী পরিবহণ সেবা
(ঙ) ডাক ও তার যোগাযোগ।
১০. আর্থিক প্রতিষ্ঠানিক সেবা: এ খাতের হিসাব করা হয় সেবা থেকে প্রাপ্ত মূল্যেও ভিত্তিতে। এ খাত তিনটি উপখাতে বিভক্ত
(ক) ব্যাংক,
(খ) বীমা ও
(গ) অন্যান্য।
১১. রিয়েল এস্টেট ও অন্যান্য: এ খাত থেকে জিডিপি পরিমাণ হিসাব করা হয় সেবা থেকে প্রাপ্ত আয়ের পরিমাপের উপর।
১২. লোক প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা: এ খাতের হিসাব করা হয় ব্যয়ের দিক দিয়ে।
১৩. শিক্ষা: এ খাতটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ খাতের হিসাব হয় ব্যয় এর দিক থেকে।
১৪. স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা: এ খাতের জিডিপি হিসাব হয় ব্যয় হিসাব দ্বারা।
১৫. কমিউনিটি, সামাজিক ও ব্যাক্তিগত সেবা: এ খাতটি হিসাব হয় ব্যয়ের হিসাবের মাধ্যমে।
ঘ) আনুমানিক তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মাথাপিছু জিডিপি নির্ণয়:
ব্যয় পদ্ধতি অনুসারে,
মনে করি, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে এটি দেশের মধ্যে অবস্থানরত সকল জনগণের ভোগ ব্যয় ৫০ লক্ষ টাকা, মোট বিনিয়োগ ব্যয় ২৫ লক্ষ টাকা এবং সরকারি ব্যয় ১০ লক্ষ টাকা।এবং এই দেশের বর্তমান মোট জনসংখ্যা ১ কোটি। এরূপ পরিস্থিতিতে মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন বা মাথাপিছু অভ্যন্তরীণ উৎপাদন নির্ণয়-
আমরা জানি,
Gross Domestic Product (GDP) = C+I+G
মোট দেশজ উৎপাদন = ভোগ+বিনিয়োগ+সরকারি ব্যয়
= ৫০+২৫+১০ লক্ষ টাকা
= ৮৫ লক্ষ টাকা