ক. প্রাক-বিপ্লর ফ্রান্সের সামাজিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা
সামাজিক অবস্থা
ফরাসি দেশের সমাজব্যবস্থা বিশেষ অধিকার ও অসাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ জন্য বলা হয়ে থাকে যে, “The Revolution of 1789 was much less rebellion against despotism than a rebellion against in equality.” (১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লব ছিল স্বৈরাচারী শাসন অপেক্ষা অধিকতর বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ)। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয় সমাজ বিশেষ করে ফ্রান্সে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল, যথা যাজক শ্রেণি, অভিজাত শ্রেণি এবং সাধারণ শ্রেণি। প্রতিটি শ্রেণিকে এস্টেট (Estate) বলা হতো। যাজক ও অভিজাত শ্রেণি ছিল যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেট। সাধারণ লোকেরা ছিল Third Estate বা তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু ভূমিকেই সম্পদের প্রধান উৎস বলে মনে করা হতো, সেহেতু ভূমির মালিকানাই সামাজিক প্রতিপত্তি লাভের চাবিকাঠি ছিল। যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় ভূমির মালিকানা ও নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করত। যাজক শ্রেণি দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা- উচ্চতর যাজক (Upper Clergy), অধস্তন যাজক (Lower Clergy)। ফ্রান্সে যাজকের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার যাজকরা প্রার্থনা ও উপাসনা ছাড়া শিক্ষাদান, দরিদ্রসেবা, জন্ম-মৃত্যুর হিসাব রাখা প্রভৃতি কাজের দায়িত্ব বহন করতেন। গির্জার উচ্চ যাজক যথা– বিশপ শ্রেণি ছিল সাধারণত অভিজাত পরিবারের লোক গির্জার জমিদারির আয়, গির্জার বিভিন্ন উপস্বত্ব তারা ভোগ করত। সমাজে তাদের দারুণ প্রতিপত্তি ছিল। উচ্চ যাজকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং শাসনকার্যে অংশ নিতেন। ফরাসি মন্ত্রী নেকারের মতে, ফরাসি গির্জার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ১৩ কোটি লিভর (ফরাসি পাউন্ড)। কিন্তু তারা আধ্যাত্মিক কোনো দায়িত্বই পালন করতেন না।
অভিজাত শ্রেণি ছিল ইউরোপের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাবান ও সুবিধাভোগী শ্রেণি ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে অভিজাতদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার। দেশের জনসংখ্যার ১ শতাংশ ছিল অভিজাত। কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও এরা সমাজের সর্বাধিক প্রভাবশালী ছিল। মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ফলে অভিজাত শ্রেণির উদ্ভব হয়। অভিজাতরা ভূমি ও কৃষকদের উপর বহু অধিকার ভোগ করত। এরা বংশানুক্রমিকভাবে ভূমির উপর অধিকার ভোগ করত। অভিজাত শ্রেণি সরকারকে কর দেওয়ার ব্যাপারে বহু ছাড় ও সুবিধা ভোগ করত।
অভিজাতরা নানা প্রকার সামন্ত কর পেত। ম্যানর প্রথা বা খামারপ্রথার ফলে অভিজাতরা ম্যানর থেকে নানাভাবে অর্থ পেত। এছাড়া তারা রাজার সভাসদ, সেনাপতি, উচ্চ কর্মচারী হিসেবে কাজ করার একচেটিয়া অধিকার ভোগ করত । এরা যুদ্ধবিগ্রহ, শাসনকার্য পরিচালনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাজার সহায়তা করত। মোটকথা, অষ্টাদশ শতক ছিল ইউরোপে অভিজাত বা সামন্ত শ্রেণির কর্তৃত্বের যুগ।
তৃতীয় শ্রেণি বা Third Estate বলতে অভিজাত ও যাজক ছাড়া বাকি সকল লোককে বোঝাত। ধনী বুর্জোয়া যথা— শিল্পপতি, ব্যাংক মালিক প্রমুখের অর্থকৌলীন্য থাকলেও জন্মকৌলীন্যের অভাবে তারা তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত ছিল। ফরাসি দেশে ধনী বুর্জোয়াদের নাম ছিল haute bourgeois বা তুটে বুর্জোয়া। বুদ্ধিজীবী ও চাকরিজীবী সম্প্রদায়, যথা- শিক্ষক, আইনজীবী, সাধারণ কর্মচারী প্রমুখও তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের মধ্যবিত্ত বা পাতি বুর্জোয়া বলা হতো। এই শ্রেণিও কায়িক শ্রমের দ্বারা জীবিকা অর্জন করত না। তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল কৃষকরা। কৃষক শ্রেণি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা- স্বাধীন কৃষক ও ভূমিদাস। ভূমিদাস শ্রেণি মালিককে বিভিন্ন কর দিত, যাজককে ধর্ম কর দিত, মালিকের জমিতে বেগার খাটত। এরা অত্যন্ত দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাত। তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার কিছুই ছিল না। কৃষক শ্রেণিই ছিল সমাজের সম্পদের উৎপাদনকারী। কিন্তু অভিজাত বুর্জোয়া ও শহরবাসীরা এদের হীন চোখে দেখত। তারা মনে করত যে, কৃষকরা ছিল নিরক্ষর কুৎসিত শ্রেণি। জমি চাষ করতে কর দিতে ও উচ্চ শ্রেণির সেবা করতে কৃষকরা জন্মগ্রহণ করেছে। কৃষকদের জীবন ছিল শোষিত, করভারে জর্জরিত এবং অভিজাতদের দ্বারা নির্যাতিত। ঐতিহাসিক C. D. Hazen এ প্রসঙ্গে বলেন, এ সমস্ত কর দেওয়ার ফলে কৃষকরা প্রায় অনাহারে থাকত।
অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এই শ্রেণির প্রভাব ইউরোপের সকল দেশে সমান ছিল না। সামন্তপ্রথার ফলে ফ্রান্সে অভিজাতদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। অভিজাত শ্রেণি জন্মকৌলীন্যের জোরে সবকিছুই ভোগ করত। বুর্জোয়া শ্রেণি অর্থকৌলীন্যে বলীয়ান হলেও সমাজে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল না। পূর্ব ইউরোপে বুর্জোয়াদের সংখ্যা ছিল নামমাত্র অস্ত, বৈষম্যমূলক করব্যবস্থা, ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রতি সরকারি উদাসীনতা বুর্জোয়া শ্রেণিকে সামস্ত শাসনের প্রতি বিরূপ করে তোলে। বুর্জোয়ারা ছিল শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। এরা এজন্য পুরাতনতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা হারায় এবং বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়। ঐতিহাসিক রাইকার ফরাসি বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, ফরাসি বিপ্লব মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সাম্য লাভের আন্দোলনের ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল।
গ্রামে ও শহরে এক শ্রেণির ভূমিহীন দিনমজুর ও শ্রমিক ছিল। এদের বাসগৃহ বা চাষের জমি বলতে কিছুই ছিল না। এরা অপরের জমিতে দিনমজুরি খাটত। শহরে এলে এরা কারখানার কাজ বা গৃহভৃত্যের কাজ করত। অভিজাতরা এই সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণিকে সমাজের নিম্নশ্রেণি বলে গণ্য করত। এছাড়া ভিক্ষুক ও উপজীবিকাহীন লোকও এ যুগে দেখা যেত। ফ্রান্সের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ ছিল উপজীবিকাহীন লোক। বিপ্লবের সময় এরা প্যারিসের জনতার সাথে যোগ দিয়ে ধ্বংসকারী মূর্তি ধারণ করে নেপোলিয়নের মতে, “ফরাসি বিপ্লব সুবিধা ভোগকারী এবং ক্ষমতালিলু শ্রেণির বিরুদ্ধে একটি সুসংগঠিত জাতীয় গণ আন্দোলন।” (The french Revolution was a general mass movement of the nation against the Privileged classes.”)”
অর্থনৈতিক অবস্থা
অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের অর্থনীতি একটি পরিবর্তনমুখী অবস্থায় উপনীত হয়। মধ্যযুগের শেষ দিক থেকে কৃষির পাশাপাশি শিল্প, বাণিজ্য ও উপনিবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যদিও অষ্টাদশ শতকে কৃষিই ছিল অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি, তবু শিল্প, বাণিজ্য ও মূলধন নিয়মিতভাবে বেড়ে পুরাতন সমাজের চরিত্রে পরিবর্তনের সূচনা করে। অর্থনীতিতে কৃষিরই ছিল অগ্রাধিকার। সমাজে মর্যাদালাতের প্রধান উপায় ছিল ভূসম্পত্তির মালিকানা। এমনকি বণিকরা বাণিজ্যে ভালো অর্থ রোজগার করার পর সে অর্থে জমি কিনে জমির মালিকানাকে তাদের আয় ও সম্মান লাভের পথ মনে করত। বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষাবাদের ব্যবস্থা তেমন ছিল না। দরিদ্র ও নিরক্ষর কৃষকরা এসব বিষয় বুঝত না লেফেভারের মতে, কৃষকরা বৃষ্টি ও প্রকৃতির দয়ার উপর নির্ভর করে কৃষিকাজ করত। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে কৃষকের দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকত না। জমিগুলো পালাক্রমে আবাদ করে এর উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করা হতো না।
মার্কান্টাইল মতবাদ বা সংরক্ষণবাদ অনুযায়ী খাদ্যশস্য দেশের বাইরে রপ্তানি করা নিষিদ্ধ ছিল। খাদ্যশস্য রপ্তানি ও অবাধ বিক্রি নিষিদ্ধ থাকায় খাদ্যদ্রব্যের ন্যায্য দাম পাওয়া যেত না। সরকার মনে করত, কৃষকরা উদ্বৃত্ত খাদ্য চালান দিলে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবে।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংরক্ষণবাদকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। আলোচিত রাজা লর্ড অ্যাক্টনের মতে, “মার্কান্টাইলবাদ ছিল আলোচিত স্বৈরতন্ত্রের অনুরূপ বা অনুপূরক অর্থনৈতিক মতবাদ।” মার্কান্টাইলবাদীরা বিশ্বাস করত যে, পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। সুতরাং বিদেশি মাল অবাধে আমদানি করলে বা খাদ্যদ্রব্য অবাধে রপ্তানি করলে সম্পদ ক্ষয় পাবে। ফলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য চলত না। সেজন্য আমদানি মালের উপর আমদানি শুল্ক বাড়ানো হতো।
মার্কান্টাইল বা সংরক্ষণবাদের বিরুদ্ধে ফিজিওক্র্যাট (Physiocrats) নামক অর্থনীতিবিদরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। অবাধ বাণিজ্যবাদীরা একথা বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, বিশ্বে সম্পদের সীমা নেই। যতই খাদ্য ও শিল্পবস্তুর উৎপাদন বাড়বে ততই সম্পদ বাড়বে। এজন্য তারা শিল্প-বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ লোপ এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্যের দাবি জানান মার্কান্টাইলবাদজনিত সংরক্ষণনীতির ফলে বাণিজ্যমন্দা এবং দারিদ্র্য বাড়ছে, একথা বোঝাতে তারা চেষ্টা করেন। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ফিজিওক্র্যাটদের তীব্র সমালোচনার ফলে সংরক্ষণবাদের তীব্রতা কিছুটা কমে যায়। তবু ইউরোপীয় শাসকদের চিন্তা মার্কান্টাইলবাদের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়নি।
ইউরোপের সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলো অষ্টাদশ শতকের উপনিবেশের সঙ্গে বাণিজ্য স্থাপনের চেষ্টা চালায়। ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন এ বিষয়ে কৃতিত্ব দেখায় ভারত ও উত্তর আমেরিকায় উপনিবেশ দখলের জন্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে ১৭৪০-৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহ দেখা দেয়। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে শতকরা ৪০ ভাগ বাণিজ্য উপনিবেশের সাথে চলত। উপনিবেশের সম্পদ ও দক্ষিণ আমেরিকার সোনা, রুপা আমদানির ফলে ইউরোপের এক শ্রেণির বণিকের হাতে প্রভূত সম্পদ জমা হয়। এরা মূলধনী বা ক্যাপিটালিস্ট (Capitalist) শ্রেণিতে পরিণত হয়। এই শ্রেণি তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারকে সুদে ধার দিত। বাকি অর্থ শিল্পে ও ব্যাংকে লগ্নি করত। এদের মূলধনের সাহায্যে লন্ডনের বেরিং (Baring), আমস্টারডামের হোপ (Hope), ফ্রান্সের সুইস (Swiss) ব্যাংক প্রভৃতি বিখ্যাত ব্যাংক চালু হয়। মোটকথা, অষ্টাদশ শতকে কৃষির কথা বাদ দিলে শিল্প-বাণিজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া দেখা যায়। বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল পরিবর্তনের অগ্রদূত। এই পরিবর্তনের চাপে পুরাতন কৃষিকেন্দ্রিক সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির ধ্বংসের পথ পরিষ্কার হয়। ফরাসি বিপ্লব ছিল তারই প্রকাশ।
রাজনৈতিক অবস্থা
অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সসহ ইউরোপে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল। এ সম্পর্কে সি. ডি. এম. কেটেলবির মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, “অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ গণতান্ত্রিক কিংবা জাতীয়তাবাদী কোনোটাই ছিল না, আসলে সেগুলো ছিল রাজবংশসম্ভূত এবং রাজ্যকে রাজার ব্যক্তিগত কিংবা রাজবংশের সম্পত্তি বলে মনে করা হতো।” রাজাই ছিলেন সর্বেসর্বা। রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি ও রাজ্য বিস্তারকে জাতির শক্তি ও মর্যাদার চিহ্ন বলে ধরা হতো। রাজা স্বর্গীয় অধিকার নীতি অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি দাবি করতেন যে, তার কাজের জন্য তিনি একমাত্র ঈশ্বরের নিকট দায়ী পার্থিব কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ অনুযায়ী তিনি চলবেন না। এভাবে রাজার স্বর্গীয় অধিকার তত্ত্ব মধ্যযুগের শেষ দিকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপের রাজনৈতিক চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এ মতবাদের আশ্রয় নিয়ে রাজারা যারপরনাই স্বৈরাচারী হন। ফ্রাস্ত্রের বুরবো রাজবংশ ছিল রাজকীয় স্বৈরাচারী ক্ষমতার প্রকৃষ্ট নিদর্শন ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই ঘোষণা করেন যে, ‘আমিই রাষ্ট্র’ রাজশক্তিগুলো বংশানুক্রমিকভাবে শাসন করত। ইউরোপের জনসাধারণের বা প্রজাদের স্বাধীনতা বলে কিছুই ছিল না। অধিকাংশ দেশের শাসনব্যবস্থা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী। জনসাধারণের ব্যক্তিস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের অধিকার ছিল না রাজা ও ধর্মযাজকরা একযোগে জনসাধারণকে শাসন করতেন ন্যায়বিচার বা আইনের শাসন ছিল না। কারণ বিচারব্যবস্থা রাজার হুকুমেই চলত। ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই ছিলেন অযোগ্য ও অকর্মণ্য। দেশ শাসন করার নৈতিক অধিকার তিনি হারিয়ে ফেলেন।
খ. ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের লেখনীর গুরুত্ব
ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান
যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিতে সবকিছু বিচার করার মানসিকতাই ছিল জ্ঞানদীপ্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য। অষ্টাদশ শতাব্দী ছিল আধুনিক ইতিহাসে জ্ঞানদীপ্তির যুগ। রেনেসাপ্রসূত অনুসন্ধিৎসা ও সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি উত্ত শতাব্দীতে কার্যকর ছিল। জ্ঞানদীপ্তির প্রভাবে উদ্দীপ্ত এক শ্রেণির পণ্ডিত ফ্রান্সের পূর্বতন শাসনামলের তীব্র সমালোচনা করে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার স্তদ্রগুলোকে নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন। ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে মন্টেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো, দিদারো প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
অনেকের মতে, বিপ্লবে দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব গ্রহণ করেননি বা অংশগ্রহণ করেননি। তবে স্বীকার করতে হবে যে, দার্শনিকদের প্রকৃত কার্যের ক্ষেত্র ছিল মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং ভাব-জগতে নতুন ভাবধারার সৃষ্টি করা অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নীতিগত অধিকার সম্পর্কে তারা জনগণকে সচেতন করেন এবং অবহিত করেন। প্রকৃতপক্ষে এখানেই দার্শনিকদের অবদান।
মন্টেন্ধু (১৬৮৯-১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দ): ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন মন্টেস্থ। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে বিপ্লব বিমুখ এবং রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। গণতন্ত্রে তার কোনো বিশ্বাস ছিল না। তিনি ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক তিনি তার যুক্তিবাদী মনন দ্বারা ফ্রান্সের প্রচলিত সমাজ ও শাসনব্যবস্থা বিশ্লেষণ করেন। তিনি ছিলেন ক্যাথলিক গির্জার ও রাজার সীমাহীন ক্ষমতার ঘোরবিরোধী স্বর্গীয় ‘অধিকারপ্রাপ্ত রাজতন্ত্র’ তত্ত্বকে অস্বীকার করে তিনি এর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো তুলে ধরেন। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘দ্য স্পিরিট অব লজ’ (The spirit of laws-1748) এবং ‘দ্য পারসিয়ান লেটারস্’ (The Persian Letters) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ‘Persian Letters’ নামক ব্যঙ্গাত্মক লেখার মধ্য দিয়ে ফরাসি সমাজের অন্যায় শ্রেণিবৈষম্যের প্রতি কটাক্ষপাত করেন এবং The spirit of laws’ গ্রন্থে তিনি শাসনব্যবস্থার মধ্যে আইন বিভাগ, কার্যনির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ- এই তিনটি বিভাগের ক্ষমতা বিভাজনের কথা বলেছেন। কারণ তার ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্ব মতে, এই তিনটি বিভাগের ক্ষমতার একত্রীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও লোপ পায়। সুতরাং মন্টেস্কুর রচনা জনগণকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিল। তিনি স্বৈরতন্ত্রের যে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করেন এবং বিকল্প হিসেবে ক্ষমতা বিভাজনের যে প্রস্তাব দেন তা সমকালীন যুগে গভীর প্রভাব বিস্তার করে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মন্টেস্কু ফরাসি বিপ্লব দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তার লেখনী ফরাসি জনতার মননে ব্যাপক প্রতিঘাত সৃষ্টি করেছিল। এজন্য ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লব-পরবর্তী সংবিধানে তার ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ব্যবহারিক প্রয়োগ করা হয়।
ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দ): ভলতেয়ার ছিলেন ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভাবান। তার প্রকৃত নাম ফ্রাঁসোয়া ম্যারি অ্যারাউয়ো। তিনি নাটক, কাব্য, ইতিহাস, প্রবন্ধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন। তার লেখাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে Oedipe, Letters Philosophiques Elements of Essays on Universal History এবং Zodig” তার লেখার লক্ষ্য ছিল চার্চের দোষ-ত্রুটি এবং ধর্মের সঙ্গে যুক্ত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করা। তিনি আপসহীনভাবে সামন্তপ্রথা ও খ্রিষ্টানধর্মের গৌড়ামিবিরোধী ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী ও অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী এক দার্শনিক। তাকে মানবজাতির ‘বিবেক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও পরমতসহিষ্ণুতার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। তিনি প্রচলিত রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মনীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে ফরাসি বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করেন। তিনি গির্জার দুর্নীতি ব্যঙ্গাত্মক লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করলে গির্জার প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা ও ভীতি কমে যায়। তার বিখ্যাত উক্তি হলো, “ঈশ্বর না থাকলে তাকে বানাতে হতো। কেননা, প্রকৃতি বলছে ঈশ্বর আছে।”
রুশো (১৭১২-১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দ): বিপ্লবের প্রেরণা সৃষ্টিতে রুশোর অবদানও কিন্তু কম ছিল না। তিনি ফ্রান্সে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী প্রচার করেন। সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র ছিল তার আদর্শ। তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে New Heloisic Confession, Emile ও Social Contract বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার বিখ্যাত সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট (Social Contract 1762) গ্রন্থ দ্বারা শাসনক্ষেত্রে জনমত তথা জনগণই সার্বভৌম এই মতবাদ প্রচার করেন। মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু মানুষ সর্বত্রই শৃঙ্খলবদ্ধ’- রুশোর এই মতবাদ বিপ্লবীদের কল্পনার আগুনে ফুলকি ধরিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে রুশো ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের অগ্রদূত রুশো তার বিখ্যাত রচনায় এ সত্য প্রচার করেন যে, ঈশ্বর রাজা বা রাষ্ট্র সৃষ্টি করেননি। আদিতে সব মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে স্বাধীন ও সুখী ছিল। জনসাধারণই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস। সুতরাং রাজা জনসাধারণের মতানুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। তার এ তত্ত্ব ইউরোপীয় চিন্তাজগতে এক বৈপ্লবিক চেতনার জন্ম দেয়। এ কারণে রুশোকে ফরাসি বিপ্লবের মন্ত্রগুরু বলা হয়ে থাকে। ডেনিস দিদারো (Denis Diderot) বিপ্লবের অব্যবহিত পূর্বের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ছিলেন ডেনিস দিদারো। | তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া বা বিশ্বকোষ রচনা করে ফ্রান্সে যুক্তিবাদী দৃষ্টি গঠনে সহায়তা করেছিলেন। এই গ্রন্থে মানুষের জ্ঞাতব্য সবকিছুই সন্নিবেশিত করা হয়েছিল এবং তদানীস্তন সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনাও এ গ্রন্থে লিখিত হয়েছিল। মানুষের জন্মগত অধিকার, মানবধর্ম, শিক্ষা বিষয়ে তথ্যপূর্ণ লেখা ছিল এ গ্রন্থে, যা বঞ্চিত মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে উজ্জীবিত করে।
এভাবে দেখা যায় যে, বিভিন্ন পণ্ডিত, জ্ঞানী দার্শনিকদের লেখনীর মাধ্যমে ফরাসি জনগণের মন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। তবু ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান সম্পর্কে ঐতিহাসিক বা গবেষকগণ একমত নন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ফরাসি বিপ্লব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেই সংঘটিত হয়েছিল, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক কারণে নয়। এই বিতর্কের গভীরে না গিয়েও বলা যায় যে, দার্শনিকদের এভাবে দেখা যায় যে, বিভিন্ন পণ্ডিত, জ্ঞানী দার্শনিকদের লেখনীর মাধ্যমে ফরাসি জনগণের মন জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। তবু ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান সম্পর্কে ঐতিহাসিক বা গবেষকগণ নন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ফরাসি বিপ্লব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেই সংঘটিত হ সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক কারণে নয়। এই বিতর্কের গভীরে না গিয়েও বলা যায় যে, দার্শনিক প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই বিপ্লবকে উৎসাহিত করেছিল। কারণ দার্শনিকগণ তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দোষ-ত্রুটির প্রতি ফরাসি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক বিরাট জাগরণের সৃষ্টি করেছিলেন। তারা এভাবে পূর্বতন শাসনের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিলেন, ফলে বিপ্লব সম্ভবপর হয়েছিল। একথা মানতে হবে যে, দার্শনিকদের সমালোচনা ও যুক্তিবাদী রচনা ফরাসি জনগণকে বিপ্লব সংঘটনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলেছিল। সুতরাং ফরাসি বিপ্লবে মহান দার্শনিকদের প্রভাব ও অবদান ছিল অপরিসীম ও অনস্বীকার্য।
গ. বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ
ফরাসি বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ
ছোট-বড় নানা কারণের সমষ্টি ছিল ফরাসি বিপ্লব। ১৭৮৯-৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ফ্রান্সে সংঘটিত ধারাবাহিক বৈপ্লবিক ঘটনার সমষ্টিকেই সাধারণত ফরাসি বিপ্লব নামে অভিহিত করা হয়। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সুবিধাভোগী শ্রেণির অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ বিপ্লবের সূচনা হয়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভূমিকা বিচার করলে ফরাসি বিপ্লবকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা- অভিজাত, মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া শ্রেণি, শহুরে জনগণ ও গ্রামীণ কৃষক । প্রথম পর্যায়ের বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিল অভিজাত শ্রেণি, দ্বিতীয় পর্যায়ে বিপ্লবের নেতৃত্ব চলে যায় মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়াদের হাতে। তৃতীয় পর্যায়ে শহরাঞ্চলে গণবিপ্লব শুরু হয়। সর্বশেষ কৃষকবিপ্লব দেখা দেয়। বিপ্লবের গতি যেমন ছিল বৈচিত্র্যময়, তেমনি ছিল ব্যাপক। ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে যখন ষোড়শ লুই ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন ফ্রান্সের অর্থনৈতিক জীবনে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। পূর্ববর্তী শাসক চতুর্দশ লুইয়ের শাসনামলে টুর্গো ও নেকার অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রস্তাব করলেও সুবিধাবাদীদের বিরোধিতার মুখে তা কার্যকর হয়নি। ষোড়শ লুই অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব মোকাবিলা করার জন্য নতুন করারোপের সিদ্ধান্ত নিলে প্যারিসের পার্লামেন্ট তার বিরোধিতা করে। পার্লামেন্টারিয়ানরা মৃতপ্রায় ‘States General’-এর অধিবেশন আহ্বানের পরামর্শ দেন রাজা বাধ্য হয়ে ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ মে States General’-এর অধিবেশন আহ্বান করেন।
‘States General’ তিন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত ছিল। জাতীয় মহাসংকটের সময় যখন ১৭৬ বছর পর এটি পুনরুজ্জীবিত হলো তখন শাসনতন্ত্রের প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিল। এর সদস্যসংখ্যা ছিল ১,২১৪। যাজক সম্প্রদায় অর্থাৎ প্রথম শ্রেণির সদস্যসংখ্যা ছিল ৩০৮, অভিজাত সম্পদায়ের ২৮৫ এবং তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্য ছিল ৬২১ জন, তন্মধ্যে ৩৬০ জন ছিলেন আইনজীবী। সকল সদস্যের ভোটাধিকার ছিল না। সকল সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত ১টি করে মোট ৩টি ভোট ছিল। স্বার্থের খাতিরে ১ম ও ২য় সম্প্রদায় বা শ্রেণি সর্বদাই এক থাকত। তাই ৩য় সম্প্রদায় অধিবেশনের শুরুতে প্রত্যেককে ভোটাধিকার দেওয়ার দাবি জানায়। তৃতীয় সম্প্রদায় অর্থাৎ সাধারণ জনতার প্রতিনিধিরা প্রত্যেকে ভোটাধিকারপ্রাপ্ত হলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হবেন এ আশঙ্কায় রাজা তাদের দাবি অগ্রাহ্য করলেন। তারা তাদের দাবিতে অনড় রইলেন। অবশেষে তারা (১৭ই জুন ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে) নিজেদের ফ্রান্সের National Assembly বলে ঘোষণা করলেন। তাদের যুক্তি ছিল, তারা ফরাসি জাতির ৯৬% জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সুতরাং তারাই সমগ্র জাতির মুখপাত্র মূলত এ সময় থেকেই ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়।
রাজা যাজক ও অভিজাতদের প্ররোচনায় ৩য় সম্প্রদায়কে দমন করার জন্য জাতীয় পরিষদের (National Assembly) অধিবেশন স্থগিত করলেন। ৩য় সম্প্রদায় ২০শে জুন তারিখে অধিবেশনের সময় এসে দেখে সভাগৃহ বন্ধ ও ফটকে সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা ‘মিরাবোর নেতৃত্বে পার্শ্ববর্তী টেনিস খেলার মাঠে সমবেত হলো। এখানে তারা এ সম্পর্কে শপথ নেয় যে, যত দিন তারা ফ্রান্সের জন্য শাসনতন্ত্র রচনা করতে না পারবে এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারবে তত দিন পর্যন্ত তারা সংঘবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবে। ইতিহাসে তা ‘টেনিস কোর্টের’ শপথ নামে পরিচিত। সভাপতি বেইলি বলেন, “তৃতীয় শ্রেণি হলো প্রকৃত জাতি, একে কারও আদেশ করার অধিকার নেই।” অতঃপর ষোড়শ লুই চিরাচরিত প্রথানুযায়ী অধিবেশন আহ্বান করেন এবং আলাদাভাবে ভোট প্রদানের কথা সকলকে জানিয়ে দেন। এতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১ম ও ২য় সম্প্রদায় অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করলেও ৩য় সম্প্রদায় সভাকক্ষে বসে রইল। তাদের কক্ষ ত্যাগের নির্দেশ দিলে ‘মিরাবো’ দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “আমরা জনগণের প্রতিনিধি, আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ স্থান থেকে বহিষ্কার করতে হলে একমাত্র বলপ্রয়োগ ছাড়া অন্য কিছুতে সম্ভব নয়। ” পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে রাজা ৩য় সম্প্রদায়ের দাবি মেনে নিলেন এবং সকল সম্প্রদায়কে একই সভায় বসার ও প্রত্যেককে ১টি করে ভোট দেওয়ার অনুমতি দিলেন।
ঘ. ফরাসি জনজীবনে বিপ্লবের প্রভাব
পৃথিবীর ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লব এক যুগান্তকারী আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাস্তিল দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে যে বুর্জোয়া বিপ্লবের সূচনা হয় তা পূর্বতন সমাজের পতনের পূর্বাভাস বলা যায়। বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। সাধারণ কৃষক শ্রেণি বিপ্লবে অংশ নিয়ে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটায়। ফলে তা প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের’ রূপ নিয়ে ফ্রান্সে পৌর-বিপ্লবের সূচনা করে। আবার একপর্যায়ে বিপ্লবের নেতৃত্ব উগ্রপন্থি জেকোবিন দলের নিকট চলে যাওয়ায় তা ‘গণবিপ্লব’ হিসেবে আখ্যা পায়। যে বিপ্লবের নামেই তাকে আখ্যায়িত করা হোক না কেন তা সর্বজনীনভাবে ফরাসি বিপ্লব নামে স্বীকৃত; যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘটে জুলাই (১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে) ও ফেব্রুয়ারি (১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে) বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল নিম্নরূপ
ক) সামন্তপ্রথার বিলোপ: ফরাসি বিপ্লবের ফলে পতনোন্মুখ সামন্তপ্রথার অবসান ঘটে। অভিজাত সম্প্রদায়ের সামন্তপ্রথাজনিত বিশেষ অধিকার খর্ব হয় সামন্তপ্রথাজনিত সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের ক্ষমতা লোপ পায়। গিল্ড প্রথার বিলোপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
খ) নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের স্থলে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম একটি সাফল্য। রাজার সীমাহীন ক্ষমতা খর্ব করা হয়। রাজার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। রাজার ক্ষমতা প্রতিনিধি সভার অধীন করা হয়।
গ) বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ফরাসি বিপ্লবের একটি বড় অবদান হচ্ছে বিপ্লবী চেতনার সঞ্চার বিপ্লবের মূলমন্ত্র স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর বাণী ইউরোপের সর্বত্র স্বাধিকারের বীজ ছড়িয়ে দেয়। ফরাসিরা গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে আরও বিপ্লবের জন্ম দেয়।
ঘ) গির্জার সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ ফরাসি বিপ্লবের আরও একটি সফল দিক হলো, ফরাসি সমাজের দুর্নীতির প্রতীক গির্জার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও রাষ্ট্রীয়করণ। এতে শত-সহস্র বছরের সঞ্চিত ধর্মান্ধতা, হীনম্মন্যতা ও অসহিষ্ণুতা দূরীভূত হয়। ‘পুরোহিতদের নাগরিক সংবিধান-১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ’ নামে আইনের দ্বারা পোপের ধর্মীয় প্রভাব সীমিত করা হয়, ধর্মযাজকের সংখ্যা হ্রাস করে ক্ষমতা খর্ব করা হয়।
ঙ) মানুষের মৌলিক অধিকার ঘোষণা: ফরাসি বিপ্লবের আরেকটি সাফল্য হলো মানুষের মৌলিক অধিকার – ঘোষণা ও এর মূলনীতিসম্বলিত প্রস্তাব গ্রহণ। রুশোর গণতান্ত্রিক ভাবধারায় পুষ্ট হয়ে এবং আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জাতীয় পরিষদ এ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ছিল ফ্রান্সের ম্যাগনাকার্টা ফরাসিরা শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, সাম্যবাদ ও স্বাধিকারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সূচনার প্রেরণা পায় এ ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে।
চ) সীমাবদ্ধ ভোটাধিকারের প্রচলন গণপরিষদের সদস্যরা জনসাধারণের সীমাবদ্ধ ভোটাধিকারের মধ্যেমে নির্বাচিত হবেন, যা ছিল ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম সাফল্য। যদিও সর্বজনীন ভোটাধিকারের প্রচলন বিপ্লবীদের দাবি ছিল। সম্পত্তির ভিত্তিতে জনসাধারণকে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় নাগরিক হিসেবে বিভক্ত করা ভোটাধিকার প্রয়োগের নেতিবাচক দিক বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ে এটুকু প্রাপ্তিও ছিল অনেক।
ছ) রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ফ্রান্সে চারটি রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয়। যথা
১। প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থি দল, যারা পূর্বতন শাসনতন্ত্র ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধার পক্ষপাতী ছিল।
২। নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রপন্থি বা মধ্যপন্থি নিরপেক্ষ দল, যারা ইংল্যান্ডের ন্যায় ফ্রান্সে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র স্থাপনের পক্ষপাতী ছিল।
৩। রাজতন্ত্রবিরোধী বামপন্থি উগ্র জেকোবিন দল।
৪। রাজতন্ত্রবিরোধী নরমপন্থি গিরোডিস্ট দল।
জ) স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠা স্থানীয় শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে তা ন্যস্ত করা ছিল ফরাসি বিপ্লবের উল্লেখযোগ্য ফলাফল সমগ্র ফ্রান্সকে ৮৩টি ডিপার্টমেন্টে ভাগ করা হয় এবং এগুলোকে আবার ৩৭৪টি ক্যান্টনে বিভক্ত করা হয়। ক্যান্টনগুলোকে আবার ৪8,000 কমিউনে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক অঞ্চলের শাসনভার স্থানীয়ভাবে প্রদান করা হয়। স্থানীয় শাসনব্যবস্থার প্রকৃত ক্ষমতা কমিউনগুলোর হাতে ন্যস্ত হওয়ায় রাজার প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান ঘটে।
ঝ) জাতীয়তাবাদী চেতনার সৃষ্টি ফরাসি বিপ্লবের ফলে জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব হয়। ‘জাতি দীর্ঘজীবী হোক’ বিপ্লবীদের জাতীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত এ স্লোগান একাত্মবোধ ও দেশপ্রেম জাগ্রত করে।
ঙ. বিশ্বে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব
ফরাসি বিপ্লবের ঐতিহ্য সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা ভিন্ন ভিন্ন মত ও দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক একে আঠারো শতকের অন্যান্য বিপ্লবের সাথে তুলনা করেছেন। কেউ আবার আধুনিক গণতন্ত্রে বিবর্তনে এর বিশেষ অবদানের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কেউ বা গণতান্ত্রিক নীতিমালার মূল্যায়নে জনগণের সার্বভৌমত্বের উপর বেশি জোর দিয়েছেন। মূলত ফরাসি বিপ্লবের তাৎপর্য ও প্রভাব ছিল বহুমুখী এ বিপ্লবের ফলে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজজীবন ও চিন্তাধারা, কূটনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহের সনাতন ভাবধারা সমূলে উৎপাটিত হয়। এ বিপ্লব সংঘটিত হয় জ্ঞানদীপ্ত মধ্যবিত্তের স্বার্থের অনুকূলে এবং পরিচালিত হয় একটি মধ্যপন্থি শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে।
মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষা ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদার হতে রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের সমবণ্টন, দুঃসহ অভাব-অভিযোগের সমাধান ও অযৌক্তিক-অসংগত ত্রুটির সংশোধন বিপ্লবীদের দাবি ছিল। স্বৈরাচারী শাসনের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা বিপ্লবী নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ক্রমশ মধ্যবিত্ত নরম সাংবিধানিক আন্দোলনকারীদের হাত থেকে বিপ্লবের নেতৃত্ব চলে যায় বেপরোয়া জনতার হাতে। ফলে বিপ্লবের ফলাফল ও প্রভাবে বহুমুখিতা লক্ষ করা যায়।
ইউরোপে ও বিশ্বে ফরাসি বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব নিঃসন্দেহে ফরাসি বিপ্লব ছিল ঐতিহ্যমণ্ডিত ও সর্বজনীন বিপ্লব এর প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এর প্রভাবে আন্দোলিত হয় ইউরোপসহ সারা বিশ্ব বিপ্লব শুরুর সময় ইউরোপের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিপ্লবকে স্বাগত জানায়। কিন্তু বিপ্লবোত্তর এর আবর্ত ও গতি বাড়তে থাকলে এর প্রতিক্রিয়ায় ভিন্নতা আসে। তবে নেপোলিয়নের শাসনামল এবং পরবর্তী সময়েও বিপ্লবের প্রভাব ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিদ্যমান ছিল। ইউরোপব্যাপী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে ইউরোপের রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে যুদ্ধের পথ উন্মুক্ত হয়। ইউরোপীয় শক্তিবর্গের সাথে ফ্রান্সের যুদ্ধ সৃষ্টির প্রকৃত কারণ হলো :
১। ফরাসি বিপ্লবের আবর্ত বৃদ্ধি ও বিপ্লবের গতির বহির্মুখিতা
২। ইউরোপীয় রক্ষণশীল রাজন্যবর্গের বিপ্লবভীতি। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ফ্রান্সের রাজা যোড়শ লুই ও রানি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। এতে অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া, ইংল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল প্রভৃতি রাজতান্ত্রিক দেশের রাজন্যবর্গের মধ্যে বিপ্লবভীতির সঞ্চার হয়। ফ্রান্সের বিপ্লবী ভাবধারা থেকে নিজ নিজ দেশকে রক্ষার জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রজোট গঠন করে।
৩। ফ্রান্স ‘এভিগনন’ দখল করলে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে ফ্রান্সের পররাজ্য গ্রাসের নীতি সম্পর্কিত উদ্বেগের সঞ্চার হয় এবং
৪। ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফ্রান্সের রাজ্যাংশ দখলের উদ্যোগ নেয়। অপরদিকে ফ্রান্স ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ থেকে ফ্রান্সকে রক্ষার এবং বিপ্লবের প্রভাব সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসে যুদ্ধে জড়ায়।
প্রথম দিকে ফ্রান্স শুধু বিপ্লবকে রক্ষার জন্যই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ আক্রমণাত্মক যুদ্ধে রূপ নিতে বেশি সময় লাগল না। আক্রমণাত্মক যুদ্ধের সাথে জাতীয়তাবোধের সংমিশ্রণ থাকায় বিপ্লবী যুদ্ধ সর্বগ্রাসী যুদ্ধে পরিণত হলো।
ক. ইংল্যান্ডে প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর বাণী প্রথম দিকে ব্রিটিশদের মনে তুমুল আনন্দোচ্ছ্বাস জাগিয়েছিল। ফ্রান্সের বুরবো রাজবংশের পতনে চিরশত্রু ইংল্যান্ড সন্তোষ প্রকাশ করেছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পিটের প্রত্যাশা ছিল, ফ্রান্সে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে উভয় দেশের বৈরিতা দূর হবে। ব্রিটিশ প্রশাসনের ধারণা ছিল, ফরাসি বিপ্লব একান্তই স্থানীয় ঘটনা, ইংল্যান্ড পর্যন্ত এর প্রভাব প্রসারিত হবে না। কিন্তু অচিরেই ইংল্যান্ডের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় ইংল্যান্ডস্থ ফরাসি বিপ্লবের অনুসারীরা ফ্রান্সের অনুকরণে বিভিন্ন ক্লাব গঠন করতে শুরু করে। বিপ্লবের সর্বনাশা গতিধারায় ইংল্যান্ড সংক্রমিত হয়। বিপ্লবের বাড়াবাড়ি ও হিংসার ব্যাপকতা ব্রিটিশদের মনোভাবকে কঠোর করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্রিটেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা হ্রাস করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাব থেকে ইংল্যান্ড মুক্ত থাকতে পারেনি। ইংল্যান্ডের শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারে এবং ব্যাপ্টিস্ট আন্দোলনে ফরাসি বিপ্লব প্রেরণা জোগায়।
খ. প্রুশিয়ায় (জার্মানিতে প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব প্রুশিয়া ছিল বহু রাজ্যে বিভক্ত একটি রাজতান্ত্রিক দেশ। বিপ্লবের গতিধারা যাতে রক্ষণশীল প্রুশিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রুশিয়া প্রথমে রাষ্ট্রজোটের সদস্য হয়। বুরবো রাজবংশকে রক্ষার অভিপ্রায় নিয়ে বিপ্লবী ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অংশ নেয়। প্রুশিয়া-অস্ট্রিয়া স্বার্থ সংঘাতের সুযোগ নিয়ে ফ্রান্স অবশেষে যুদ্ধে জয়লাভ করে। ফলস্বরূপ প্রুশিয়া রাষ্ট্রজোট ত্যাগ করে এবং ওয়ার্টিগনিস থেকে বিতাড়িত হয়। জার্মানির উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ফরাসি বিপ্লবের প্রতি সহনশীল ছিলেন। তাদের সমর্থন নিয়ে জার্মানির স্বৈরাচার শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে নিয়মতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন শুরু হয়, যা ছিল ফরাসি বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাব
গ. অস্ট্রিয়ায় প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব অস্ট্রিয়াও ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়। অস্ট্রিয়ারাজ লিওপোল্ড ছিলেন ষোড়শ লুইয়ের ঘোর সমর্থক। বুরবো রাজবংশ প্রতিষ্ঠার জন্য প্যাড়ুয়া নামক স্থানে এক প্রচারপত্র প্রকাশ করলেন। এ প্রচারপত্রে তিনি ষোড়শ লুইয়ের সমস্যাকে নিজেদের সমস্যা বলে মনে করতে রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে অনুরোধ করেন। তিনি ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ফরাসি রাজতন্ত্রকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে লিওপোল্ড ও প্রুশিয়ারাজ ফ্রেডারিক ‘পিলনিজের’ ঘোষণা প্রচার করলেন। এতে ঘোষণা করলেন যে, বিপ্লবী ফ্রান্সের পরিস্থিতি ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের চিন্তার বিষয়। ইউরোপীয় অপরাপর রাজন্যবর্গের সাহায্য পাওয়া মাত্রই অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়া ফ্রান্সের বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। এ ভীতি প্রদর্শনের পরও ফ্রান্স ভয় পেল না। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ফ্রান্স অস্ট্রিয়াকে স্যায় থেকে উৎখাত করে স্যাভয়ের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়।
এভাবে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে যখন ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দিল, তখন ফ্রান্স ডাচদের নদী সেল্ডকে সর্বজনীন নদীপথ বলে ঘোষণা করল। এতে ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের স্বার্থহানি ঘটল। পূর্ব থেকেই অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। নতুন করে স্পেন, হল্যান্ড ও সার্দিনিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। যুদ্ধের প্রথম দিকে ফ্রান্স পর্যুদস্ত হলেও পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ায়। স্পেন রাষ্ট্রজোট ত্যাগে বাধ্য হয় এবং পিরনিজ পর্বতের ওপারে আশ্রয় নেয়। বেলজিয়াম ফরাসি সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং হল্যান্ড ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
কাজেই দেখা যায়, ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া ছিল যুদ্ধংদেহী ও বহুমুখী এবং প্রভাব ছিল ব্যাপক। কোনো বিপ্লবের বিপ্লবী ভাবধারা ও গতি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বা গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখা যায় না। ইউরোপব্যাপী এর মিশ্র ও তুমুল প্রতিক্রিয়াই এর প্রমাণ।