উত্তর:
উপসর্গ:
বাংলা ভাষায় কিছু কিছু অব্যয়সূচক শব্দাংশ বাক্যে পৃথকভাবে স্বাধীন কোনো পদ হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে বিভিন্ন শব্দের শুরুতে আশ্রিত হয়ে ব্যবহৃত হয়। এগুলোকে বলা হয় উপসর্গ। এগুলোর নিজস্ব কোন অর্থ নেই, তবে এগুলো শব্দের পূর্বে ব্যবহৃত হয়ে শব্দের অর্থের পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংকোচন সাধন করে।
উপসর্গ কোন শব্দ নয়, শব্দাংশ। এটি শুধুমাত্র শব্দের শুরুতে যোগ হয়। খেয়াল রাখতে হবে, উপসর্গ শুধুমাত্র শব্দেরই আগে বসে, কোন শব্দাংশের আগে বসে না। সুতরাং যে শব্দকে ভাঙলে বা সন্ধিবিচ্ছেদ করলে কোন মৌলিক শব্দ পাওয়া যায় না, তার শুরুতে কোন উপসর্গের মতো শব্দাংশ থাকলেও সেটা উপসর্গ নয়। এক্ষেত্রে নতুন শব্দের সঙ্গে মৌলিক শব্দটির কোন অর্থগত সম্পর্ক নাও থাকতে পারে।
শব্দের শুরুতে যোগ হয়ে এটি- নতুন শব্দ তৈরি করতে পারে, অর্থের সম্প্রসারণ করতে পারে, অর্থের সংকোচন করতে পারে এবং অর্থের পরিবর্তন করতে পারে।
উপসর্গের নিজস্ব অর্থবাচকতা বা অর্থ নেই, কিন্তু অন্য কোন শব্দের আগে বসে নতুন শব্দ তৈরির ক্ষমতা বা অর্থদ্যোতকতা আছে। যেমন, ‘আড়’ একটি উপসর্গ, যার নিজস্ব কোন অর্থ নেই। কিন্তু এটি যখন ‘চোখে’র আগে বসবে তখন একটি নতুন শব্দ ‘আড়চোখে’ তৈরি করে, যার অর্থ বাঁকা চোখে। অর্থাৎ, এখানে আড় উপসর্গটি চোখে শব্দের অর্থের পরিবর্তন করেছে। আবার এটিই ‘পাগলা’র আগে বসে তৈরি করে ‘আড়পাগলা’, যার অর্থ পুরোপুরি নয়, বরং খানিকটা পাগলা। এখানে পাগলা শব্দের অর্থের সংকোচন ঘটেছে। আবার ‘গড়া’ শব্দের আগে বসে তৈরি করে ‘আড়গড়া’ শব্দটি, যার অর্থ আস্তাবল। এখানে আবার শব্দের অর্থ পুরোপুরিই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, উপসর্গের নিজস্ব অর্থবাচকতা না থাকলেও তার অর্থদ্যোতকতা আছে। উপসর্গ অন্য কোন শব্দের আগে বসে নতুন শব্দ তৈরি করতে পারে।
নিচে বাংলা উপসর্গগুলোর প্রয়োগ দেখানো হলো-
উপসর্গ অর্থ উদাহরণ/ প্রয়োগ
১ অ নিন্দিত অকেজো (নিন্দিত কাজ করে যে), অচেনা, অপয়া
অভাব অচিন (চিন-পরিচয়ের অভাব), অজানা, অথৈ
ক্রমাগত অঝোর (ক্রমাগতভাবে ঝরতে থাকা), অঝোরে
২ অঘা বোকা অঘারাম, অঘাচন্ডী
৩ অজ নিতান্ত/ মন্দ অজপাড়াগাঁ (একেবারে নিতান্তই পাড়াগাঁ), অজমূর্খ, অজপুকুর
৪ অনা অভাব অনাবৃষ্টি (বৃষ্টির অভাব), অনাদর
ছাড়া অনাছিষ্টি (সৃষ্টিছাড়া), অনাচার
অশুভ অনামুখো (অশুভ, মুখ যার অশুভ)
৫ আ অভাব আলুনি (লবনের অভাব), আকাঁড়া, আধোয়া
প্রত্যয় :
যেসব বিষয় নিয়ে আজকের আলোচনা হয়েছে সেগুলো হল প্রাতিপদিক, ক্রিয়ামূল বা ধাতু, প্রকৃতি, প্রত্যয়, নাম প্রকৃতি, ক্রিয়া প্রকৃতি, কৃৎ প্রত্যয়, তদ্ধিত প্রত্যয়, কৃদন্ত পদ, তদ্ধিতান্ত পদ, গুণ, বৃদ্ধি, ইৎ, কৃৎ প্রত্যয়,বাংলা কৃৎ প্রত্যয়, সংস্কৃত কৃৎ প্রত্যয়, তদ্ধিত প্রত্যয়, বাংলা তদ্ধিত প্রত্যয়,সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয়, বিদেশি তদ্ধিত প্রত্যয় ইত্যাদি।
মূলশব্দ বা মৌলিক শব্দের সঙ্গে যে অতিরিক্ত শব্দাংশ যুক্ত হয়ে নতুন নামপদ গঠন করে, তাকে প্রত্যয় বলে। অর্থাৎ, প্রাতিপদিক ও ধাতুর সঙ্গে যেই শব্দাংশ যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে, তাদেরকেই প্রত্যয় বলে। উপরের উদাহরণে, লাজুক শব্দের প্রকৃতি ‘লাজ’-এর সঙ্গে প্রত্যয় ‘উক’ যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে ‘লাজুক’ শব্দটি। এমনিভাবে
১ নং সূত্র:
শব্দের শেষে যদি ”ব” প্রত্যয় যুক্ত থাকে তাহলে আমরা মূল শব্দের সাথে “ষ্ণ” যুক্ত করবো। উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।
উদাহরণ:
মানব=মনু+ষ্ণ । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
দানব=দনু+ষ্ণ । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
ইত্যাদি।
২ নং সূত্র:
শব্দের শেষে যদি ”মা” এবং ”ম”প্রত্যয় থাকে তাহলে আমরা মূল শব্দের সাথে “ইমন” যুক্ত করবো। উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।
উদাহরণ:
নীলিমা=নীল+ইমন । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
পূর্ণিমা =পূর্ণ +ইমন । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
দ্রাঘিমা =দীর্ঘ +ইমন । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
মহিমা =মহৎ +ইমন । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
৩ নং সূত্র:
শব্দের শেষে যদি ‘ইক’ প্রত্যয় থাকে তাহলে আমরা মূল শব্দের সাথে “ষ্ণিক” যুক্ত করবো। উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।
উদাহরণ :
সাহিত্যিক=সাহিত্য+ষ্ণিক । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
সামাজিক =সমাজ +ষ্ণিক । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
হৈমন্তিক =হেমন্ত +ষ্ণিক । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
ধার্মিক =ধর্ম +ষ্ণিক । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
৪ নং সূত্র:
শব্দের শেষে যদি ‘মান’প্রত্যয় থাকে তাহলে আমরা মূল শব্দের সাথে “মতুপ/শানচ” যুক্ত করবো। উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।
উদাহরণ:
কীর্তিমান =কীর্তি+মতুপ/শানচ । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
বুদ্ধিমান =বুদ্ধি +মতুপ/শানচ । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
শ্রীমান =শ্রী+মতুপ/শানচ । এটি তদ্ধিত প্রত্যয়।
বর্তমান=√বৃত+মতুপ/শানচ । এটি কৃৎপ্রত্যয়।
বর্ধমান =√বৃধ+মতুপ/শানচ । এটি কৃৎপ্রত্যয়।
আপনার হয়তো লক্ষ্য করেছেন, এখান ” মতুপ” ও “শানচ” দুটোই ব্যবহার করা হয়েছে। এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন হতে পারে দুইটার কোনটি ইউজ করব। এখানে উত্তর হচ্ছে যেকোনো একটি ব্যবহার করলেই হবে। এতে কোন সমস্যা নেই। যেহেতু যেকোনো একটি ব্যবহার করলেই হবে তাই আমরা উদাহরণে দুটোই ব্যবহার করে দেখিয়েছি।
সমাস বাংলা:
১: সমাস নির্ণয় করার আগে সমস্তপদটির অর্থ জানতে হবে। সমস্তপদের অর্থ না জেনে সমাস নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব। এখানে আরও একটি কথা বলে রাখা ভালো, কোনো শব্দের প্রচলিত অর্থ ও মূল অর্থ আলাদা হলে মূল ও আদি অর্থটিই সমাস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে। যেমন: গবেষণা শব্দের ব্যাসবাক্য হবে গো-এর এষণা, অর্থাৎ গোরু খোঁজা। বর্তমানে এই অর্থে শব্দটির ব্যবহার হয় না, কিন্তু সমাসে এই অর্থটিই ধরতে হবে। এর কারণ, সমাসবদ্ধ শব্দটি যখন তৈরি হয়েছিল, তখন এই ভাবেই হয়েছিল।
২: সমাস নির্ণয়ের দ্বিতীয় ধাপে ব্যাসবাক্য নির্ণয় করতে হবে। ব্যাসবাক্য নির্ণয় করতে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। যদি সমাসবদ্ধ শব্দটির অর্থ জানা থাকে, তাহলে শব্দের মূল অর্থটিকে বিশ্লেষণ করলেই ব্যাসবাক্যটি পাওয়া যায়। এখানে খেয়াল রাখতে হবে, সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ও সবচেয়ে যথাযথ বিশ্লেষণটি করতে হবে। যথাসম্ভব কম শব্দ ব্যবহার করতে হবে। এক একটি ব্যাসবাক্যকে চাইলে বড়ো করা যায়, কিন্তু তা করা যাবে না।
৩: সমাস নির্ণয়ের তৃতীয় ধাপে দেখতে হবে অর্থপ্রাধান্য কোন পদটির আছে। অর্থপ্রাধান্য নির্ণয় করা খুব কঠিন কাজ নয়। একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে।
যেমন: হিমশীতল = হিমের মতো শীতল। অর্থাৎ বরফের মতো ঠাণ্ডা। এখন দেখতে হবে সমস্তপদটি কাকে বোঝাচ্ছে, বরফকে, নাকি শীতলকে। হিমশীতল বললে কি বরফ বোঝায়? নাকি খুব ঠাণ্ডা বোঝায়? লক্ষণীয় বিষয়: পরপদটি বিশেষণ, সমস্তপদটিও বিশেষণ। তাই এভাবেও বোঝা যাচ্ছে পরপদের প্রাধান্য।
আর একটি উদাহরণ নিয়ে দেখি: আকণ্ঠ = কণ্ঠ পর্যন্ত। আকণ্ঠ বললে কণ্ঠকে বোঝায়, নাকি কণ্ঠ পর্যন্ত বিস্তৃতি বোঝায়? সহজেই বুঝতে পারছি আকণ্ঠ বলতে কারও গলা বোঝাচ্ছে না, পর্যন্তের ভাবটিই প্রাধান্য পাচ্ছে।
৪: চতুর্থ ধাপে এসে সমাসের নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। পূর্বপদ, পরপদ বা অন্যপদের অর্থপ্রাধান্য পেয়ে যাওয়ার পর আমরা সমাসকে মূল ভাগগুলিতে বিভক্ত করে ফেলতে পারবো। পরপদ প্রধান হলে তৎপুরুষ, কর্মধারয়, দ্বিগু বা নিত্য সমাস হবে। অন্যপদ প্রধান হলে বহুব্রীহি হবে ও উভয়পদ প্রধান হলে দ্বন্দ্ব হবে। অব্যয়ীভাব হবে নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে। সমাসের মূল তিনটি আলোচনায় এই বিষয়ে বলেছি।