উত্তর সমূহ
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণঃ
পলাশি যুদ্ধের একশ’ বছর পর ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে প্রধানত সিপাহিদের নেতৃত্বে যে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত হয় , তাকেই ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক। শোষণ , সামাজিকভাবে হেয় করা , ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা।
সর্বোপরি ভারতীয় সৈনিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ- এসবই এই সংগ্রামের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। নিম্নে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো।
রাজনৈতিক: পলাশি যুদ্ধের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজ্য বিস্তার, একের পর এক দেশীয় রাজ্যগুলো দখল, দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে ভীতি , অসন্তোষ ও তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। লর্ড ডালহৌসি।
স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, সম্বলপুর, ভগৎ, উদয়পুর, করাউলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। স্বত্ববিলোপ নীতি অনুযায়ী দত্তক পুত্র সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারত না। তাছাড়া অপশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়। এসব ঘটনায় দেশীয় রাজন্যবর্গ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন।
অর্থনৈতিক: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু। হয় চরম অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চনা। কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষমতা। দখলের আগেই এদেশের শিল্প ধ্বংস করেছিল। ক্ষমতা দখলের পর ভূমি রাজস্ব নীতির নামে ধ্বংস করা হয় দরিদ্র কৃষকের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড আইন প্রয়োগের ফলে অনেক বনেদি জমিদার সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। দরিদ্র কৃষকের ওপর অতিরিক্ত কর ধার্য করা হয়। জমিদার ও রাজস্ব আদায়কারীদের তীব্র শোষণের শিকার এসব কৃষক মহাজনদের কাছে।
ঋণগ্রস্ত হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। একদিকে বাজার দখলের নামে স্থানীয় শিল্প ধ্বংস, অপর দিকে অতিরিক্ত অর্থ লাভের আশায় জমি বন্দোবস্তের নামে কৃষি ধ্বংস হয়। ফলে বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। এঅবস্থার শিকার সাধারণ মানুষ কোম্পানি শাসন – শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
সামাজিক ও ধর্মীয়: উপমহাদেশের জনগণের ক্ষোভের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল সামাজিক ও ধর্মীয়। আঠারো শতকের শেষ ভাগে এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্যের প্রভাব, কোম্পানির সমাজ সংস্কার জনকল্যাণমূলক হলেও গোটা রক্ষণশীল হিন্দু-মুসলমান এসব মেনে নিতে পারেনি। ইংরেজি শিক্ষা, সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ, হিন্দু বিধবাদের পুনরায় বিবাহ, খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের ধর্ম প্রচার ইত্যাদির ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের গোঁড়াপন্থীরা শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ধর্ম ও সামাজিক রীতিনীতি বিভিন্নভাবে সংস্কারের কারণে ক্ষুব্ধ হয় উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ।
সামরিক : সামরিক বাহিনীতে ইংরেজ ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যকার বৈষম্য বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। ইংরেজ মেন্য ও ভারতীয় সিপাহিদের মধ্যে পদবি এবং বেতন – ভাতার মধ্যে বিরাট বৈষম্য ছিল। ভারতীয়দের সুযোগ – সুবিধাও কম ছিল। তাছাড়া পদোন্নতির সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত ছিল। তার ওপর ব্রিটিশ অফিসারদের পক্ষপাতিত্ব।
গুদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সিপাহিদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তাছাড়া হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সিপাহিদের ব্যবহারের জন্য, এনফিল্ড ‘ রাইফেলের প্রচলন করা হয়। এই রাইফেলের টোটা দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকে প্রবেশ করাতে হতো। সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপকভাবে এ গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, এই টোটায় গরু ও শুকরের চর্বি মিশ্রিত আছে। ফলে উভয়ই ধর্মনাশের কথা ভেবে বিদ্রোহী হয়ে উঠল।
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বঃ
এই বিদ্রোহের তাৎক্ষণিক গুরুত্বও ছিল। এর ফলে কোম্পানি শাসনের অবসান হয়। ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করে। ১৮৫৮ সালের ১ লা নভেম্বর মহারানি ভিক্টোরিয়ার এক ঘোষণাপত্রে স্বত্ববিলোপ নীতি এবং এর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য নিয়ম বাতিল করা হয়। তাছাড়া এই ঘোষণাপত্রে।
১ যোগ্যতা অনুযায়ী ভারতীয়দের চাকরি প্রদান এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তাসহ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয়।
এই বিদ্রোহের সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব হচ্ছে এই বিদ্রোহের ক্ষোভ থেমে যায়নি। এই সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ সচেতন হয়ে ওঠে এবং আন্দোলন – সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটায়।
বঙ্গভঙ্গের কারণ: বঙ্গভঙ্গের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল, যা নিচে উল্লেখ করা হলো প্রশাসনিক কারণ: লর্ড কার্জনের শাসনামলে বঙ্গভঙ্গ ছিল একটি প্রশাসনিক সংস্কার। উপমহাদেশের এক তৃতীয়াংশ লোকের বসবাস ছিল বাংলা প্রেসিডেন্সিতে।
কোলকাতা থেকে পূর্বাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও শাসনকার্য সুষুঠভাবে পরিচালনা করা ছিল কঠিন কাজ। যে কারণে লর্ড কার্জন এত বড় অঞ্চলকে একটি প্রশাসনিক ইউনিটে রাখা। যুক্তিসংগত মনে করেননি। তাই ১৯০৩ সালে বাংলা প্রদেশকে ভাগ করার। পরিকল্পনা করেন এবং ১৯০৫ সালে তা কার্যকর হয়।
আর্থ-সামাজিক কারণঃ বাংলা ভাগের পেছনে আরো কারণ ছিল যার একটি অর্থনৈতিক, অপরটি সামাজিক তখন কোলকাতা হয়ে উঠেছিল। আর্থ – সামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। শিল্প কারখানা, ব্যবসা – বাণিজ্য, অফিস – আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কোলকাতাকে ঘিরে। যা কিছু উন্নতি অগ্রগতি, সবই ছিল কোলকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে, পূর্ব বাংলার উন্নতি ব্যাহত হয়। অথচ এখান থেকে যে কাঁচামাল সরবরাহ করা হতো তার জন্যও সুষুঠ যোগাযোগব্যবস্থা ছিল না।
ফলে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমে খারাপ হতে থাকে। উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে না। পারায় এ অঞ্চলের লোকজন অশিক্ষিত থেকে যায়। কর্মহীনের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যেতে থাকে। এ অবস্থার কথা বিবেচনা করে বঙ্গভঙ্গের প্রয়োজন ছিল।
রাজনৈতিক কারণ: লর্ড কার্জন শুধু শাসন – সুবিধার জন্য বা পূর্ব । বাংলার জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে বঙ্গভঙ্গ করেননি। এর পেছনে ব্রিটিশ প্রশাসনের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত ছিল। লর্ড কার্জন বাংলার রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ক্রমশ জাতীয়তাবাদ ও রাজনীতি। সচেতন হয়ে উঠেছিল। বিষয়টি তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। কংগ্রেস নেতারা কোলকাতা থেকেই সারা ভারতের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন।
সুতরাং কোলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। হিন্দু ও মুসলমান সম্মিলিত শক্তি, ঐক্যবদ্ধ বাংলা ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের জন্য বিপজ্জনক। ফলে বাংলা ভাগ করে একদিকে বাঙালির শক্তিকে দুর্বল করা হলো, অপরদিকে পূর্ব বাংলার উন্নয়নের নামে। মুসলমান সম্প্রদায়কে খুশি করা হলো। এভাবেই কার্জন’ বিভেদ ও শামন’ নীতি প্রয়োগ করে যতটা না পূর্ব বাংলার কল্যাণে,
তার চেয়ে বেশি ব্রিটিশ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বাংলা ভাগ করেন। এভাবে কৌশলে ভারতীয় জাতীয় ঐক্যকে দুর্বল করার ব্যবস্থা করা হলো।
বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া: বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার ফলে বাংলার মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায়। মুসলিম পত্র – পত্রিকাগুলোও বঙ্গ বিভাগে সন্তোষ প্রকাশ করে। নতুন প্রদেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল মুসলমান। সুতরাং পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলমান। সম্প্রদায় শিক্ষা – দীক্ষা এবং প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ – সুবিধা পাবে এ আশায় তারা বঙ্গভঙ্গের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করে।
অপরদিকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। এর পেছনের কারণ সম্পর্কে কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন উঁচুতলার মানুষ অর্থাৎ পুঁজিপতি, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, জমিদার, আইনজীবী, সংবাদপত্রের মালিক, রাজনীতিবিদদের স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে এরা বঙ্গভঙ্গের ঘোর বিরোধিতা শুরু করে। তবে ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার কারণে। হোক বা জাতীয় ঐক্যের মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হোক ,
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, অশ্বিনীকুমার দত্ত, বালগঙ্গাধর তিলকসহ গোখলের মতো উদারপন্থী নেতাও অংশ নেয়। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বঙ্গভঙ্গকে জাতীয় দুর্যোগ বলে আখ্যায়িত করেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ক্রমে স্বদেশী। আন্দোলনে রূপ নেয়। চরমপন্থী নেতাদের কারণে এই আন্দোলনের সঙ্গে সশস্ত্র কার্যকলাপও যুক্ত হয়। ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকারীদের দমন করতে না পেরে
শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত করে। রাজা পঞ্চম জর্জ ভারত। সফরে এসে ১৯১১ সালে দিল্লির দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দেন। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হিন্দু সম্প্রদায় খুশি হয়, আর কংগ্রেস মনে করে এটি। তাদের নীতির জয়। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গ রদে প্রচণ্ড মর্মাহত হয়। ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেসের প্রতি তাদের আস্থা নষ্ট হয়ে। যায়। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে কংগ্রেস মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়। মুসলিম নেতৃবৃন্দ একে ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার জঘন্য উদাহরণ বলে মন্তব্য করেন।
বঙ্গভঙ্গের পর থেকে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে ফাটল ধরে। এরপর থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হলে হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক পথ আলাদা হয়ে যায়।
মুসলমানদের জন্য ক্রমশ স্বতন্ত্র জাতি – চিন্তা তীব্র হতে থাকে।