করােনার সময়ে অভিভাবকরা যে বিষয়ে তাঁদের উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন তা হচ্ছে, করােনাকালীন শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারনেট ব্যবহারজনিত আসক্তি। আর এটি আরাফাতের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়েছে। ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে করােনা মহামারিজনিত কারণে সারা দেশের স্কুল-কলেজগুলাের সরাসরি শ্রেণিপাঠদান বন্ধ রয়েছে। পড়াশােনা চালিয়ে নিতে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সােশ্যাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার শুরু হয় এপ্রিল মাস থেকেই। দেশের অগ্রগণ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাে শিক্ষকদের দ্রুত এই নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাহনাভাওক পাঠদান কর্মসূচি শুরু করে।
করােনার বিস্তারের কারণে হােম কোয়ারেন্টিন, লকডাউন, জুম, গুগল মিট ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের ছাত্রসমাজের দ্রুত পরিচয় ঘটে। করােনা ছড়িয়ে পড়ার আগে শিক্ষার্থীরা সীমিত পর্যায়ে শুধু বন্ধু বা পারিবারিক যােগাযােগ আর গেমস খেলার জন্য বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করত। অনলাইনে পড়াশােনা শুরু হওয়ায় তাদের সেসব যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গিয়েছে। পড়াশােনার স্বার্থেই অনেক অভিভাবক সন্তানের হাতে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, ট্যাব বা স্মার্ট মােবাইল তুলে দিয়েছেন।আরাফাতের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও শিক্ষার্থীদের বাসায় অবস্থানের কারণে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইসগুলাের ব্যবহার কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনলাইনে সংযুক্ত হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধু এবং সহপাঠীদের সঙ্গে একসঙ্গে শিখতে পারছে।
৯ম শ্রেণির ২১তম সপ্তাহের শারীরিক শিক্ষা এসাইনমেন্ট সমাধান বা উত্তর
ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য বিনােদনমূলক কার্যক্রম, সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধির অনুশীলন, তথ্য আদান-প্রদানসহ অনেক মূল্যবান | ক্ষেত্রের সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়কে ‘স্ক্রিন টাইম’ বলা হয়। ইন্টারনেটের সুদূরপ্রসারী ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম’ শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতিকর। এর ব্যবহার যখন মাত্রা ছড়িয়ে যায় তখন এটা ‘আসক্তি’র পর্যায়ে পড়ে। এখানে সপ্তাহে ৩৮ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ইন্টারনেট ব্যবহার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারার কারণে বিষন্নতা, আবেগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়াকে ‘আসক্তি’ হিসেবে পশ্চিমা গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। ইন্টারনেট ও ডিজিটাল সামগ্রী হাতের কাছে পেয়ে আরাফাতের মতাে শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে আমাদের ছাত্রসমাজ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিন বা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকায় চোখের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। ফলে অল্প বয়সী বাচ্চাদের আজকাল ভারী চশমা ব্যবহার করতে দেখা যায়। ইন্টারনেট আসক্তির কারণে শিক্ষার্থীদের অনিদ্রা, ক্ষুধামান্দ্য, হজমে সমস্যা, ঘাড় ও কোমর ব্যথা, মােটা হয়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এই আসক্তি তাদের খিটখিটে মেজাজ, অল্পতেই ধৈর্যচ্যুতি, টেনশন বােধ, বিষন্নতা, পারিবারিক সৌজন্যবােধের অভাবজনিত বিভিন্ন মানসিক সমস্যা তৈরি করছে। উপরােক্ত সমস্যা গুলাে আরাফাতের আচরণে লক্ষ্য করা যায়।
আরাফাতের মতাে উদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে উত্তরনের জন্য আমাদের যা যা করতে হবে তা নিচে উল্লেখ কথা হলাে :
১. ইন্টারনেটের অপব্যবহার রােধ এবং এর আসক্তি থেকে পরিত্রাণের জন্য শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ আমাদের শিক্ষকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
২. শিক্ষার্থীদের বুঝাতে হবে নিজের ভালাের জন্য এই ‘আসক্তি থেকে তাদের দ্রুত মুক্তি পেতে হবে।
৩. মন ভালাে করার জন্য ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে সহায়তা করতে হবে।
৪. ইন্টারনেট আসক্তি দূর করতে ধীরে ধীরে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে।
৫. তাদের বুঝতে হবে যে ইন্টারনেট আসক্তি তােমার পরিবার এবং বন্ধুদের সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।
আরাফাতের মতাে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে অভিভাবকদের ও যে যে বিষয়ে নজর দিতে হবে তা হলােঃ
১. শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইস আসক্তি কমাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন পরিবারের সহযােগিতা। তাই তাকে সর্বক্ষণ সহযােগিতা করতে হবে।
২. তাকে পত্রিকা পড়ানাে, বই পড়ানাে, টিভিতে খবর দেখানাে, গল্প করার মাধ্যমে বাস্তবজগতে নিয়ে আসতে হবে।
৩. ইন্টারনেটের কুফল থেকে সন্তানদের বাঁচাতে খেলাধুলা ও পরিবারের সদস্যদের সময় দেওয়া একান্ত প্রয়ােজন।
৪. সন্তান কখন কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে চলছে সে বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে।
৫. সপ্তাহে অন্তত একদিন তাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যান।
ইতিবাচক সামাজিক মূল্যবােধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবােধ, সহানুভূতি, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি একজন শিক্ষার্থীকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরাপদ রাখতে সহায়তা করবে বলে আমি মনে করি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে তৈরি করার জন্য এই মহামারি পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিবারের ও শিক্ষকদের সহনশীল আচরণ করা প্রয়ােজন। ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীরা যেমন প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে, তেমনি পর্যাপ্ত ইন্টারনেট ব্যবহারে সে যেন যত্নশীল থাকতে পারে সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আশা করি ডিজিটাল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা ইন্টারনেটের কুপ্রভাব থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে পরিবারের ও সমাজের মধ্যে মুখ উজ্জ্বল করে সামনে এগিয়ে যাবে। সর্বশেষ বলা যায়, উপরােক্ত দিকগুলাে বাস্তবায়ন করতে পারলে আরাফাতের সমস্যা গুলাে পরিত্রান করতে সম্ভব হবে।