মূলধন হলো ফিন্যান্স এর একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া, যা প্রতিষ্ঠনের দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তের সাথে জড়িত। বিশদভাবে বলতে গেল, প্রত্যেকটি বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের বা প্রকল্পের আয়-ব্যয় প্রাক্কলন করতে হয়। আয়-ব্যয় প্রাক্কলন শেষে এসব সিদ্ধান্তের বা প্রকল্পের নিট নগদ প্রবাহ বা নিট মুনাফা নির্ধারণ করা হয়। আবার নিট মুনাফার সাথে অবচয় যোগ করে নগদ আন্তঃপ্রবাহ নির্ণয় করা হয়। আর এই আন্তঃপ্রহের সাথে প্রারম্ভিক বিনিয়োগ বা নগদ বহিঃপ্রবাহের তুলনা করে যদি আন্তঃপ্রবাহ বহিঃ প্রবাহ হতে বেশি হয় তাহলে বিনিয়োগটি লাভজনক প্রতীয়মান হয় এবং গারহণযোগ্য বিবেচিত হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকেই মূলত মূলধন বাজেটিং বলা হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বা কোনো প্রকল্প নির্বাচনে মূলধন বাজেটিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন- আমার পরিবার প্ৰতিনিয়ত যে মুদি দোকানটি হতে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করে থাকে, সেই দোকানে একটি ফ্রিজ আছে যা হতে দোকানদার নানা রকম আইসক্রিম, কাঁচা পিঠাসামগ্রী বিক্রম করেন। তবে তার কাছে প্রায় সময় মানুষ কোমল পানীয় সামগ্রী চাই, এতে তিনি সাধারণ কোমল পানীয় দিলে তারা নিত চাই না, বলে সামান্য ঠান্ডা থেকে দিতে। তাই তিনি চিন্তা করছেন একটি নরমেল ফ্রিজ কেনার। এক্ষেত্রে তিনি যে প্রক্রিয়া বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন তা হলো মূলধন বাজেটিং।
মূলধন বাজেটিং কে অর্থায়নের সাফল্যের চাবিকাঠি বলা হয়। মূলধন বাজেটিং ব্যবসায়ের জন্য এতটায় গুরুত্বপূর্ণ যে তা সঠিক ও বাস্তবসম্মত হলে ব্যবসায়ী লাভবান হয় অন্যতায় ব্যবসায়ীকে ব্যর্থ হয়ে লোকসান বহন করতে হয়। নিচে কিছু গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:
১. সাধারণত মুনাফা অর্জনের লক্ষেই প্রতিষ্ঠান গঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে এই মুনাফা অর্জনে ব্যবসায়ীকে কিছু উপার্জনকারী স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয় করতে হয়। তবে সেক্ষেত্রে এত বড় পরিমাণ তহবিল বিনিয়োগের পূর্বে প্রতিষ্ঠানকে মূলধন বাজেটিংসিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। তাই মুনাফা অর্জন পরোক্ষভাবে মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। যেমন- কোনো দেকানির ফ্রিজ ক্রয়ের সিদ্ধান্ত।
২. মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্ত যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সাথে সম্পৃক্ত তাই এই ধরনের বিনিয়োগে অর্থের আকার বড় হয়ে থাকে। আর তা যদি যথাযথভাবে বিনিয়োগ করা না যায়, তবে ব্যবসায় লোকসানের সম্মুখীন হয়। যেমন- মধ্যবিত্ত পরিবার থাকে এমন একটি এলাকায় যদি বড় কোনো সুপারশপ খোলা হয় তবে তা তেমন ভালো চলবে না। এতে তাদেরকে একটি বড় মাশুল দিতে হবে।
৩. মূলধন বাজেটিং এর অধিকাংশ অনুমান
অনিরিক্ত ভবিষ্যতের উপর নির্ভরশীল। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে ঝুঁকি নিরূপন ও ঝুঁকির গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজন পড়ে। আর এক্ষেত্রে মূলধন বাজেটিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- একটি পোশাক শিল্প সদ্য আগত শীতে অতিরিক্ত শীত পড়তে পারে ভেবে অনেক পোশাক অর্থাৎ শীত বস্ত্র তৈরি করল। কিন্তু যদি শীত বেশি পড়ে তবে সে লাভবান হবে অন্যতায় তাকে লোকসানের ভার বহন করতে হবে।
যে কোনো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মূলধন বাজেটিং প্রক্রিয়ার প্রয়োগ করা হয়। কেননা কোনো ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান চাই না তাদের লোকসানের মুখ দেখতে না হোক। নিচে কিছু জনপ্রিয় ক্ষেত্রের বর্ণনা দেওয়া হলো যেধানে মূলধন বাজেটিং প্রয়োগ করা হয়:
১. স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয়: প্রত্যেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কিছু না কিছু স্থায়ী সম্পত্তি অবশ্যই প্রয়োজন হয়। ছোট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কম হতে পারে কিন্তু একেবারেই যে প্রয়োজন হয় না এমনটি নয়। যেমন- একদম ছোট হিসেবে অস্থায়ী ভ্যানে সবজি বিক্রয় করা ব্যক্তির নিজের জন্য ভ্যান, ওজন মাপার যন্ত্র ইত্যাদি জিনিস লাগে তেমনি বড় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হতে পারে জমি, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির। সেক্ষেত্রে সম্পত্তি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে মূলধন বাজেটিং অসাধারণ ভূমিকা পালন করে।
২. ব্যবসার পণ্য উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে সম্প্রসারণ: কোনো প্রতিষ্ঠান শুরু করার পর একসময় তাদের সেবা ক্রেতাদের পছন্দ হলে বিক্রয় বাড়তে পারে এমতাবস্থায় তাদের প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে হয়ত নতুন যন্ত্রপাতি, আসবাব বা দালান ইত্যাদি ক্রয়ের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন – একটি সেলুন গ্রাহকদের চুল সুন্দর করে কাটলে, ভালো ব্যবহার করলে তার ব্যবসায়ের সুনাম বাড়তে পারে তখন তার হয়ত চুল কাটার চেয়ার, মেশিন ইত্যাদি ক্রয়ের প্রয়োজন পড়ে। সে সময় এসর ক্রয় কত ব্যয় হবে, কত আয় বাড়বে ইত্যাদি প্রাক্কলন করা হয় মূলধন বাজেটিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
৩. পণ্য বৈচিত্রায়ণ: প্রতিষ্ঠানের পরিধি বৃদ্ধির জন্য অনেক সময় নতুন পণ্য বাজারে আনতে হয়। যেমন- ভ্যানিলা আইসক্রিমের পাশাপাশি স্ট্রবেরি আইসক্রিম ছাড়তে পাড়ে। তবে এক্ষেত্রে পণ্যের আয়ুষ্কাল, উৎপাদন খরচ, বাজার চাহিদা, পরিচালনা খরচ এবং সম্ভাব্য আয় প্রাক্কলন করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এক্ষেত্রে মূলধন বাজেটিং এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
৪. প্রতিস্থাপন ও আধুনিকায়ন: ব্যবসার প্রয়োজনে উৎপাদন পদ্ধতির প্রতিস্থাপন ও আধুনিকায়নের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে উৎপাদন খরচ কমানো এবং এর মাধ্যমে ব্যবসার লাভ বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে কোম্পানির পুরাতন উৎপাদন পদ্ধতির সাথে নতুন পদ্ধতির তুলনা প্রয়োজন হয়। যেমন- সেলুনে তারযুক্ত মেশিনের পরিবর্তে তারবিহীন মেশিনের ব্যবহার।
মূলধন বাজেটিং প্রক্রিয়া বেশ কিছু ধাপ অনুসারে সম্পাদন করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে মূলধন বাজেটিং-প্রক্রিয়ার ধাপগুলো নিম্নরূপ:
ক) নগদ প্রবাহ প্রাক্কলন
খ) বাট্টা হার নির্ধারণ
গ) মূলধন বাজেটিং পদ্ধতি নির্বাচন ও প্রয়োগ
ক) নগদ প্রবাহ প্রাক্কলন: মূলধন বাজেটিং-প্রক্রিয়া প্রয়োগের প্রথম ধাপ হচ্ছে নগদের আন্তঃপ্রবাহ ও বহিঃপ্রবাহ প্রাক্কলন করা। প্রতিষ্ঠানের নগদ প্রবাহ করতে প্রতিষ্ঠানকে বিক্রয় পূর্বানুমান, চলতি খরচ পূর্বানুমান, মূলধনি ব্যয় এবং অন্যান্য ব্যয় নির্ধারণ করতে হয়। বিক্রয় থেকে প্রতিষ্ঠানের নগদ আস্তঃপ্রবাহ ঘটে এবং চলতি খরচ, মূলধনি ব্যয় এবং অন্যান্য খরচ পূর্বানুমান থেকে নগদ বহিঃপ্রবাহ ঘটে। এখানে বিক্রয় অনুমান, চলতি খরচ, স্থায়ী খরচ প্রত্যেকটি বিষয় অতি সতর্কতার সাথে নির্ধারণ করতে হয়। এগুলো পূর্বানুমানের পর প্রতিবছর বিক্রি থেকে মোট অর্জিত আয় পাওয়া যায়। এই অর্জিত আয় থেকে নগদ আন্তঃপ্রবাহ পাওয়া যায়। অতএব বলা যায়, নগদ প্রবাহের সঠিক প্রাক্কলন নির্ভর করে পণ্যের ভবিষ্যৎ বছরগুলোতে বিক্রয়মূল্য এবং কতগুলো পণ্য বিক্রয় হবে তার উপর। অনুরূপভাবে প্রতিষ্ঠানের মোট খরচের মাধ্যমে নগদ বহিঃপ্রবাহ ঘটে। একটি প্রতিষ্ঠানের চলতি খরচ এবং স্থায়ী খরচ মিলে মোট খরচ হয়। বিক্রয় অনুমানের মতো প্রত্যেক চলতি খরচ এবং স্থায়ী খরচ পূর্বানুমানে অতি সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কোনো কারণে এসব খরচ অনুমানে ভুল হলে মূলধন বাজেটিং ভুল সিদ্ধান্ত দিতে পারে, যে কারণে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ।
খ) বাট্টা হার: নগদ প্রবাহ নির্ধারণ করার পর সেগুলোকে নগদ মূল্যে রূপান্তর করার জন্য বাট্টা হার প্রয়োজন হয়।
ভবিষ্যৎ বছরগুলোতে আগত নগদ প্রবাহের পরিমাণ সমান হলেও সেগুলোর বর্তমান মূল্য সমান হয় না। অর্থের সময়মূল্য অনুযায়ী নগদ প্রবাহ যত দেরিতে পাওয়া যায়, সেটির বর্তমান মূল্য তত কম। বিনিয়োগ সুযোগ বা প্রকল্প থেকে যেহেতু বেশ কয়েক বছর ধরে নগদ প্রবাহ পাওয়া যায়, সেহেতু মূলধন বাজেটিং-এর মাধ্যমে সঠিক বিনিয়োগ সুযোগ নিতে হলে ভবিষ্যতে আগত নগদ প্রবাহগুলোর বর্তমান মূল্য নির্ণয় করতে হয়। এ কারণে বাট্টা হারের প্রয়োজন হয়।
গ) মূলধন বাজেটিং পদ্ধতির প্রয়োগ: নগদ প্রবাহ প্রাক্কলন এবং বাট্টা হার নির্ধারণের পর মূলধন বাজেটিং পদ্ধতি নির্বাচন করতে হয়। কেননা মূলধন বাজেটিং এর বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে। প্রত্যেকটি পদ্ধতির কিছু সুবিধা অসুবিধা রয়েছে। বিনিয়োগ সুযোগ বা প্রকল্পের ধরন, ঝুঁকি এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে সঠিক পদ্ধতিটি নির্বাচন করতে হয়।
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান আর মূলধন বাজেটিং একে অপরের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ব্যবসায়ের স্থায়ী বিনিয়োগে মূলধন বাজেটিং অপরিহার্য। মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্তে সামান্যতম ত্রুটিও ব্যবসায়ের অস্থিত্ব অনিশ্চিত করে দেয়। তাই মূলধন বাজেটিং হতে হয় সঠিক ও বাস্তবসম্মত। এতে ব্যবসায় সফলতা অর্জিত হয় এবং দীর্ঘায়ু লাভ করে। যেমন- কোনো ব্যক্তি একটি ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় সেলুন দিতে চাইলে তার প্রথমে মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্ত নিতে হবে কেননা সে যদি প্রথমে দুটির জায়গায় চারটি চেয়ার নিয়ে কাজ শুরু করে তবে তো তাকে ক্ষতির সম্মুখীন হতেই হবে। আবার একজন সবজি ব্যবসায়ী একটি ভ্যান নিয়ে তার ব্যবসায় শুরু করতে পারে বা একটি ছোট জায়গা ক্রয় করে বা ভাড়া নিয়ে ব্যবসায় করতে পারে । তাই বলা যায়, এই ধরনের সকল দীর্ঘমেয়াদী সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ে মূলধন বাজেটিং এর গুরুত্ব অপরিসীম।