ক) বিদ্যালয় সমাজকর্মের ধারণা
পশাদার সমাজকর্মের একটি প্রায়োগিক শাখা হচ্ছে বিদ্যালয় সমাজকর্ম। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের সাথে সম্পর্কিত সমস্যাবলীকে কেন্দ্র করে বিদ্যালয় সমাজকর্ম পরিচালিত হয়। সমাজকর্মের জ্ঞান ও কলাকৌশল প্রয়োগ করে সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় পরিবেশের সাথে কাঙ্খিত সমন্বয় সাধনে সাহায্য করা এবং সমাজকর্মী কর্তৃক শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ এবং পরিবার ও সমাজের প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত ও সমন্বয় করার প্রচেষ্টাকে বিদ্যালয় সমাজকর্ম বলা হয়।
সমাজকর্ম অভিধানের (১৯৯৫) সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘‘বিদ্যালয় সমাজকর্ম সমাজকর্মের এক বিশেষায়িত শাখা যা শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের সাথে সন্তোষজনক সামঞ্জস্যবিধানে সহায়তা করে এবং এই উদ্দেশ্য অর্জনে বিদ্যালয়, পরিবার ও সমষ্টির প্রচেষ্টার সমন্বয় সাধন এবং প্রভাবিত করে (School social work is the specialty in social work oriented toward helping students make satisfactory school adjustment and coordinating and influencing the efforts of the school, the family and the community to help achieve this goal.)।’’
বিদ্যালয় সমাজকর্ম বিদ্যালয় পরিবেশে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ ও বিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সামঞ্জস্যবিধানের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। বিদ্যালয় সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের স্কুল পালানো, অমনোযোগিতা, উচ্ছৃংখল ও আক্রমনাত্মক আচরণ, বিদ্যালয় পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যহীনতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি সমস্যা মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সুতরাং বলা যায়, বিদ্যালয় সমাজকর্ম হলো সমাজকর্মের সেই বিশেষ শাখা যা সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা, মূলবোধ, কৌশল ও পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিদ্যালয় পরিবেশে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক বিকাশ ও উন্নয়নে সহায়তা করে থাকে।
খ) বিদ্যালয় সমাজকর্মের পাঁচটি গুরুত্ব
১) শিশুর প্রতিভা বিকাশ ও শিক্ষা লাভে বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিদ্যালয় পরিবেশকে শিশুর জন্য শিক্ষাবান্ধব ও সৃজনশীল করে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিবাভকদের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিদ্যালয় সমাজকর্ম গুরুত্ব ভূমিকা পালন করে।
২) বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শ্রেণি ও পরিবেশ থেকে আগত। ফলে অনেপকই বিদ্যালয় পরিবেশে খাপখাওয়াতে সক্ষম হয়না যা ঝুঁকির কারণ হিসেবে দেখা দেয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলা করাসম্ভাবপর হয় না। এক্ষেত্রে বিদ্যালয় পরিবেশে শিক্ষার্থীদের সামাঞ্জস্যবিধান, স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন,পবিবার ও সমষ্টির কার্যাবলীকে প্রভাবিত করে শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জনে বিদ্যালয় সমাজকর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৩) বদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়া, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া তথা শিক্ষা বিমুখতার পেছনে বিদ্যমান পারিবারিক, শারীরিক, মনোস্তাত্তিক ও মেধাগত কারণ নির্ণয় করে যথাপোযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে বিদ্যালয় সমাজকমের্র বিকল্প নেই বললেই চলে। বিদ্যালয়ের সকল বিত্ত, শ্রেণি ও পেশাভুক্ত পরিবেশের সন্তানেরা অধ্যয়ন করে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পেশা ও আয়ভুক্ত পরিবারের শিক্ষার্থীর মধ্যকার হীনমন্যতা ও প্রতিহিংসা দূর করে বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক ও বাঞ্ছিত শিক্ষা-আচরণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিদ্যালয় সমাজকমের্র প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
৪) বিদ্যালয় পরিবেশে শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক আচরণ যেমন স্কুল পালানো, বখাটে ও অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠা, বিদ্যালয়ভীতি, বিদ্যালয়বিমুখতা, আক্রমণাত্মক আচরণ, ধূমপান বা মাদকে আসক্ত হওয়া, যৌন হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদির পেছনে বিদ্যমান আর্থ–সামাজিক ও মনো-সামাজিক কারণ চিহ্নিত করে সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীকে সক্ষম করে তোলার ক্ষেত্রে বিদ্যালয় সমাজকমের্র গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
৫) শিল্পসমাজে শিশু-কিশোররা বিভিন্ন ধরনের মনো-সামাজিক সমস্যার কারণে সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে যা বিদ্যালয় জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। পিতা-মাতার স্নেহবঞ্চনা, বৈরি পারিবারিক পরিবেশ, আর্থিক ও মানসিক দৈনতা, শিক্ষক কর্তৃক বঞ্চনা, পারিবারিক ভাঙ্গন বা বিচ্ছিন্নতা, অসুস্থতা, প্রতিবন্ধিতা প্রভৃতি কারণ শিক্ষার্থীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমস্যাগ্রস্ত করে থাকে। শিক্ষার্থীর সাথে সংশ্লিষ্ট এসব বিয়য়ের উপর তথ্য অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ, সমস্যার কারণ নির্ণয় এবং সমাধান পরিকল্পনা প্রণয়নে বিদ্যালয় সমাজকর্মী তার পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োগ করে থাকেন।
গ) শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগীকরণে বিদ্যালয় সমাজকর্মীর ভূমিকা
অধিকাংশ জনগণ নিরক্ষর ও দারিদ্র্য কবলিত। তারা নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত নয়। এছাড়া ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা দেখিয়ে দেয়ান জন্য গৃহশিক্ষক রাখার সামার্থ্য তাদের নেই। বিদ্যালয় শিক্ষকরাও ততটা ভাল করে পড়া বুঝিয়ে দিতে পারছেন না। এছাড়া এই গ্রামে বয়ঃসন্ধি পরপরই মেয়ে শিক্ষার্থীদের চলাফেরায় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। স্কুলে যাওয়ার পথে যৌনহয়রানির শিকার হতে হয়। তাই
’উপযুক্ত পাত্র’ পেলেই বাল্য বিবাহ দিয়ে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বিদ্যালয় সমাজকর্মী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়ন এবং গ্রামের সামাজিক পরিবেশ উন্নয়নে বিদ্যালয়, পরিবার ও সমাজে ভূমিকা পালন করে থাকেন।
এছাড়া সমাজকর্মী গতিশীলতা আনয়নকারী, সমন্বয় ও সংযোগ সাধনকারী, সচেতনতা সৃষ্টিকারী, শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকেন। পরিবর্তন প্রতিনিধি হিসেবে বিদ্যালয়ের পরিবেশগত উন্নয়ন এবং সমাজ ও পরিবেশের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক ও কাঙ্খিত পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পিতামাতার মধ্যে সংযোগ সাধনের জন্য অনুঘটকের ভূমিকাও পালন করে থাকেন।
এভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে তিনি ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের কে পাঠে মনোযোগী করতে পারেন।
ঘ) শিক্ষার্থীদের নিয়মিতকরণে বিদ্যালয় সমাজকর্মীর ভূমিকা
বিদ্যালয় সমাজকমের্র মূল দর্শন হচ্ছে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক উন্নয়ন আনয়ন করা। তাই বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পরিপূরক হিসেবে শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে বিদ্যালয় সমাজকর্মীর ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। বিদ্যালয় সমাজকর্মীরা বিদ্যালয় পরিবেশে সমাঞ্জস্যবিধানে ব্যর্থ, ঝরে পড়া, অমনোযোগী, স্কুল পালানো, অপরাধপ্রবণ, মাদকাসক্তিসহ ঝুঁকিপূর্ণ শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে শিক্ষকদের পাশাপাশি গতিশীল ও বহুমুখী ভূমিকা পালন করে থাকেন।
বিদ্যালয় সমাজকর্মীদের অন্যতম ভূমিকা হলো শিক্ষার্থীদের হতাশা, নৈরাশ্য, মানসিক চাপ, যন্ত্রনা ও অসহায়ত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে পরিবর্তন প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালন। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের স¦াভাবিক শিক্ষণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং অগ্রগতি, সমুন্নত ও গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে পরামর্শক, উদ্বুদ্ধকারী, তথ্য সরবারহকারী, তথ্য উদ্ঘাটনকারী ও সাহায্যকারী হিসেবে বিদ্যালয়ে সমাজকর্মীরা বহুমুখী ভূমিকা পালন করে থাকেন। শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও আবেগীক সমস্যা সমাধানে বিদ্যালয় সমাজকর্মী শিক্ষার্থীকে প্রত্যক্ষ সেবা প্রদান করে থাকেন। বিদ্যালয় সংক্রান্ত নীতি, পরিবেশ ও অনুশীলন যা শিক্ষার্থীদের কর্মবিমুখতা বা ত্রুটিপূর্ণ বিকাশের জন্য দায়ী তা পরিবর্তন আনয়নে পরিবর্তনকারী হিসেবেও ভূমিকা পালন করে থাকেন।
এভাবে একজন সমাজকর্মী শিক্ষার্থীদের কে বিদ্যালয়ে নিয়মিতকরণ করতে পারেন।
ঙ) শিক্ষক ও অভিভাবকের সাথে সমাজকর্মীর কাজ
শিক্ষকের সাথে সমাজকর্মীর কাজ
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের যাতে সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাঠ গ্রহণ করতে পারেন সেজন্য শিক্ষককে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করবেন । শিক্ষক অবশ্যই গণিত ইংরেজি এবং একটি বিষয়ের উপরে শিক্ষার্থীদের কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিতে পারে এমন কলাকৌশল ও পরামর্শ প্রদান করবেন। বিদ্যালয় সমাজকর্মী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষা সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ ধারণা অর্জন করবেন। অর্জিত ধারণা থেকে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা শক্ত করবেন এবং সফলতা চিহ্নিত করবেন। এ বিষয়গুলো তিনি শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করবেন। যাতে করে শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের দুর্বলতা ও সফলতার উপর ভিত্তি করে সঠিক ভাবে পাঠদান করতে পারেন।
শিক্ষার্থীরা যেন সকলে অংশগ্রহণমূলক পাঠদান গ্রহণ করে থাকে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষককে পরামর্শ দিতে পারেন। অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা অধিক ফলপ্রসূ।
শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীদের কে বাস্তব উপকরণ এর মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে পারেন সে বিষয়ে বিদ্যালয় সমাজকর্মী শিক্ষকদেরকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতে পারেন।
শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রমে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে দলীয় কাজ একটি সফল শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীর কাছে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় হলো দলগত কাজ। এর মাধ্যমে শ্রেণির সব শিক্ষার্থীকে পাঠে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। এতে বিভিন্ন মেধার শিক্ষার্থীর সমন্বয়ের মাধ্যমে শিখন দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের বৈচিত্র্য সৃষ্টিই সৃজনশীলতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই বিদ্যালয় সমাজকর্মী শিক্ষকদের সাথে যৌথ প্রচেষ্টায় শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রমে বৈচিত্র আনার চেষ্টা করবে।
অভিভাবকের সাথে সাথে সমাজকর্মীর কাজ
অভিভাবকের সাথে বিদ্যালয় সমাজকর্মীর অন্যতম কাজ হল শিক্ষার্থীরা যেন নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকেন সে বিষয়ে অভিভাবকের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশল ও পন্থা উদঘাটন করা। উদঘাটিত কৌশল বা পন্থা অবলম্বন করে শিক্ষার্থীদের নির্মিত বিদ্যালয় উপস্থিত থাকা নিশ্চিত করা।
শিক্ষার্থীরা যেন অধিক পরিমাণ পাঠ মুখস্ত না করে করে সেদিকে অভিভাবকের পাশাপাশি খেয়াল রাখা। এবং অভিভাবকদেরকে এই বিষয়ে সচেতন করা। বাড়িতে বসে যেন শিক্ষার্থীরা মনোরম পরিবেশে অধিক সময় ধরে সৃজনশীল ও বৃত্তিমূলক পড়াশোনা করতে পারে তার ব্যবস্থা করে দেওয়া।
শিক্ষা বিষয়ে সর্বশেষ সংস্কার সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত করা। একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবে তার সন্তানের বিদ্যালয়ের প্রতিদিনের শ্রেণির কাজ, বাড়ির কাজ ও অনুশীলনমূলক পরীক্ষার অগ্রগতির খোঁজ রাখা প্রয়োজন এ বিষয়ে অভিভাবক কে অবহিত করা। ফলে নিজ নিজ সন্তানেরা তাদের কাজের প্রতি আরও যত্নবান হবে।